পাহাড় সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করব যেগুলি আমাদের অবাক করে দেয়। যেমন পাহাড় হল জলের ভাণ্ডার। বলার কারণ, পাহাড়ের উপর হিমবাহ, যা আসলে বিশাল স্বাদু জলের ভান্ডার। এই হিমবাহগুলি থেকে অনেক নদীর উৎপত্তি। হিমবাহের বরফ গলা জলে পুষ্ট নদীর জলে বাঁধ নির্মাণ করে সাথে জলাধার তৈরি করে সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। সুউচ্চ পাহাড় পার্শবর্তী এলাকার জলবায়ুকেও প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ হিমালয় পর্বত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুকে বাধা দিয়ে ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়। শীতকালে মধ্য এশিয়ার ঠান্ডা বাতাস থেকেও তারা আমাদের রক্ষা করে। পার্বত্য অঞ্চল সাধারনত খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ হয় যা শিল্পের জন্য অপরিহার্য।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ: প্রকৃতির গোপন গভীর সমুদ্র
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হলো প্রকৃতির এক আশ্চর্য রহস্য। প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে, ফিলিপাইনের পূর্বে আর জাপানের দক্ষিণে লুকিয়ে আছে এই গভীর সমুদ্রের পরিখা। মনে হয়, এটা যেন পৃথিবীর হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছানোর গোপন পথ!
চ্যালেঞ্জার ডিপ – পৃথিবীর গভীরতম স্থান
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর অংশের নাম চ্যালেঞ্জার ডিপ। এটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,৯১৬ মিটার (৩৫,৮১৪ ফুট) নিচে। এতটাই গভীর যে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত এভারেস্টকে উল্টে এর মধ্যে রাখা হয়, তাও চূড়াটা জলের নিচেই থাকবে! ভাবো তো, ওখানে থাকলে মাথার ওপর ১,০০০ হাতির ওজনের চাপ পড়বে!
এটা কোথায় আর এর মজার তথ্য
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ গুয়ামের ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিমে, প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। আর এটা মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের অংশ। মজার ব্যাপার হলো, ম্যানিলা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২,৫০০ কিলোমিটার, যা অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের বেশি কাছে!
কেমন করে তৈরি হলো?
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ তৈরি হয়েছে এক বিশাল ভূতাত্ত্বিক সংঘর্ষের মাধ্যমে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট মারিয়ানা প্লেটের নিচে গিয়ে ঢুকে গেছে, আর তাই এমন গভীর পরিখা তৈরি হয়েছে। এই এলাকা “রিং অফ ফায়ার” নামে পরিচিত, যেখানে প্রায়ই ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়।
রহস্যে ভরা জগৎ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতায় সূর্যের আলো একেবারেই পৌঁছায় না। জলের চাপ এতটাই বেশি যে বেশিরভাগ সাবমেরিন পর্যন্ত এখানে যেতে পারে না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এখানে এমন সব অদ্ভুত প্রাণী থাকতে পারে, যাদের পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না।
চ্যালেঞ্জের পর চ্যালেঞ্জ
এ পর্যন্ত খুব কম মানুষই চ্যালেঞ্জার ডিপের তলদেশে পৌঁছাতে পেরেছেন। তারা মনে করেন, চাঁদে যাওয়ার চেয়েও এটা কঠিন! কারণ চাঁদে অনেক বেশি মানুষ গিয়েছেন, কিন্তু এখানে ডুব দেওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ যেন পৃথিবীর এক অজানা গভীর দানব! বিজ্ঞানীরা এর রহস্য উন্মোচনে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। এই গভীরতা আমাদের শেখায়, প্রকৃতির গোপনীয়তা আসলেই কত বিস্ময়কর আর অসীম!
আরও পড়ুন: নিজের শব্দের প্রতিধ্বনি কেবল নিজে শুনুন
ডেভিলস টাওয়ার: এক অদ্ভুত আর চমকপ্রদ পাহাড়
ডেভিলস টাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রে একটা দারুণ অদ্ভুত আর মজার পাহাড়। এটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দেড় মাইল উঁচু আর আশপাশের জমি থেকে প্রায় ৪০০ মিটার উঁচুতে উঠে গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন একটা বিশাল পাথরের টুকরো হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এর বিশেষ ব্যাপার হলো, এর মাথাটা একেবারে সমান আর পাশে পাশে এমনভাবে খাঁজ কাটা, যেন মনে হয় এক বিশাল ভালুক এসে নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে! এটা দেখে মনে হয়, প্রকৃতি যেন নিজ হাতে এই শিল্পকর্ম তৈরি করেছে।
ভাবতে অবাক লাগে, এর সৃষ্টি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর পেছনে মজার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে। চল তো, এক মিনিট ধরে আমরা কল্পনা করি, এটা কীভাবে তৈরি হলো!
বিজ্ঞানীরা ১৮০০ সালের শেষ দিক থেকেই ডেভিলস টাওয়ার নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রায় ৬ কোটি বছর আগে উত্তপ্ত ম্যাগমা (গলিত শিলা) মাটির তলা থেকে উঠে আসে, কিন্তু উপরে বের হতে পারেনি। মাটির নিচেই সেটা ঠান্ডা হয়ে শক্ত পাথরে পরিণত হয়। ঠান্ডা হতে হতে ওটার গায়ে ফাটল ধরে। এরপর লাখ লাখ বছর ধরে নরম মাটিগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলীন হয়ে যায়, আর শক্ত পাথরগুলো রয়ে যায়, যা আজ আমরা ডেভিলস টাওয়ার নামে দেখি।
ডেভিলস টাওয়ার আমাদের পৃথিবীর এক দারুণ প্রাকৃতিক বিস্ময়। এর দিকে তাকালে মনে হয়, প্রকৃতি কত সুন্দর আর রহস্যে ভরা! পৃথিবীটা সত্যিই কত মজার, তাই না?
বৈকাল হ্রদ : পৃথিবীর এক অনন্য রহস্য
সাইবেরিয়ার বরফঢাকা অঞ্চলে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ রহস্যময় হ্রদ—বৈকাল হ্রদ! এটি পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ। প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছর আগে, পৃথিবীর বুকে একটি বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছিল, আর সেই ফাটল থেকেই জন্ম নেয় বৈকাল হ্রদ। এর গভীরতা প্রায় ১,৬৪২ মিটার! আর মজার বিষয় হলো, এটি প্রতি বছর প্রায় ২ সেন্টিমিটার করে প্রসারিত হচ্ছে! কেন? কারণ এটি দুইটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝখানে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ায় প্রতি বছর হ্রদটি একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে—যেন পৃথিবী নিজেই এর বিস্তার ঘটাচ্ছে!
এই হ্রদের জল এতটাই পরিষ্কার যে গ্রীষ্মকালে ৪০ মিটার নিচের তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। আর শীতকালে বরফের নিচেও এর সৌন্দর্য গোপন থাকে না। বৈকাল হ্রদের নিচে থাকা টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়া নতুন নতুন ফাটল তৈরি করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একদিন হয়তো বৈকাল হ্রদ পুরো মহাদেশকেই দু’ভাগ করে ফেলবে!
বৈকাল হ্রদে এমন কিছু প্রাণী আছে, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত হলো বৈকাল সিল। বিজ্ঞানীরা আজও জানেন না, কীভাবে এই সিল এখানে এলো। বৈকাল হ্রদের আরেকটি বিশেষত্ব হলো, এর জলের রং। ঋতু আর আবহাওয়ার পরিবর্তনে এই জল কখনো নীল, কখনো সবুজ, কখনো কালো আবার কখনো সোনালী বর্ণ ধারণ করে!
১৯৯৬ সালে ইউনেস্কো এই হ্রদকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। লেক বৈকাল সত্যিই পৃথিবীর এক অদ্ভুত সুন্দর রহস্য!
পাহাড় সম্পর্কে কিছু তথ্য
- জলের টাওয়ার: পাহাড়গুলোকে প্রায়ই “জলের টাওয়ার” বলা হয় কারণ এরা তুষার গলে যাওয়া জল আর বৃষ্টির জল ধরে রাখে এবং তা থেকেই নদী আর ঝর্ণা তৈরি হয়। পৃথিবীর ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ স্বাদু জল এই সমস্ত পাহাড় বা পর্বত থেকেই আসে।
- আন্দিজ ও নিরক্ষরেখা: বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ পর্বতমালা আন্দিজ, সাতটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশের মধ্য দিয়ে চলে এবং নিরক্ষরেখাকে দুবার অতিক্রম করে।
- সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা: ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালায় লোহার সমৃদ্ধ পাথরের জন্য অদ্ভুত চৌম্বকিয় বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এতে কম্পাসের নির্ভুলতা ব্যাহত করতে পারে, যা অভিযাত্রীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
- হুয়াশান পর্বত: চীনের হুয়াশান পর্বতে একটি বিরল ঘটনা ঘটে, যাকে বলা হয় ট্রাইবোলোমিনেসেন্স। এতে নির্দিষ্ট কিছু খনিজ পদার্থ যান্ত্রিক চাপে একটি হালকা নীল আলো নিঃসরণ করে। সম্ভবত মহাজাগতিক রশ্মির সঙ্গে খনিজের বিক্রিয়ায় এটি ঘটে, যা চোখ ধাঁধানো অদ্ভুদ দৃশ্য তৈরি করে।
- নবীন ও প্রবীণ পাহাড়: পাহাড় সম্পর্কে কিছু তথ্য হল হিমালয়ের মতো তরুণ পাহাড়গুলো এখনও টেকটোনিক ক্রিয়াকলাপের কারণে উঁচু হচ্ছে। অন্যদিকে, উত্তর আমেরিকার অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালার মতো পুরানো পাহাড়গুলো সময়ের সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।
- পর্বত-বহুল দেশ: ভুটান পৃথিবীর সবচেয়ে পর্বত-বহুল দেশ, এর ৯৮% এরও বেশি জমি পাহাড়ে আচ্ছাদিত। এটি বিশ্বের উচ্চতম না আরোহণ করা পর্বতশৃঙ্গ গাংখার পুয়েনসাম সহ বিশ্বের কয়েকটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের আবাসস্থল।