নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প: পর্ব-১

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প
piccture credit: m.somewhereinblog.net

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কাহিনী সারা বিশ্বে প্রচলিত। অনুমান করা হয় তিনি তুরস্ক অথবা ইরানের কোন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। নাসিরুদ্দিনের উপস্থিত বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার খ্যাতি দেশ ও কালের সীমানা ছাড়িয়েছে। কোনো গল্পে তাকে পাওয়া যায় বোকা ও নেহাতই সাদাসিধে মানুষ হিসেবে। ফলে নাসিরুদ্দিন মহাবুদ্ধিমান নাকি মহাবোকা ছিলেন তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। তবে আসল ঘটনা যাই হোক, নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে আসছে। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বিশাল গল্পসম্ভার থেকে মজার কয়েকটি এখানে উপস্থাপন করা হল।

1. ধনী বাড়িতে ভোজ

এক ধনীর বাড়িতে ভোজ হবে খবর পেয়ে নাসিরুদ্দিন সেখানে গিয়ে হাজির। ঘরের মাঝখানে বিশাল টেবিলের উপর লোভনীয় সব খাবার সাজানো রয়েছে রুপোর পাত্রে। টেবিল ঘিরে চেয়ার পাতা, তাতে বসেছে হোমরা-চোমরা সব ভাইয়েরা। নাসিরুদ্দিন সেদিকে এগোতেই কর্মকর্তা তার মামুলি পোশাক দেখে তাকে ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিলেন। নাসিরুদ্দিন বুঝলেন সেখানে খাবার পৌঁছতে রাত কাবার হয়ে যাবে। সে আর সময় নষ্ট না করে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে তোরঙ্গ থেকে তার ঠাকুরদাদার আমলের একটা ঝলমলে আলখাল্লা আর একটা মণিমুক্তো বসানো আলিশান পাগড়ি বার করে পরে আবার নেমন্তন্ন বাড়িতে ফিরে গেল।

এবার কর্মকর্তা তাকে একেবারে খাস টেবিলে বসিয়ে দিলেন, আর বসামাত্র নাসিরুদ্দিনের সামনে এসে হাজির হল ভুরভুরে খুশবুওয়ালা পোলাওয়ের পাত্র। নাসিরুদ্দিন প্রথমেই পাত্র থেকে খানিকটা পোলাও তুলে নিয়ে তার আলখাল্লায় আর পাগড়িতে মাখিয়ে দিলে। পাশে বসেছিলেন এক আমীর। তিনি ভারী অবাক হয়ে বললেন, জনাব, আপনি খাদ্যদ্রব্য যেভাবে ব্যবহার করছেন তা দেখে আমার কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অর্থ জানতে পারলে আমি বিশেষ বাধিত হব।

অর্থ, খুবই সোজা, বললে নাসিরুদ্দিন। এই আলখাল্লা আর এই পাগড়ির দৌলতেই আমার সামনে এই ভোজের পাত্র। এদের ভাগ না দিয়ে আমি একা খাব সে কি হয়?

2. হাঁস উপহার – নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

একদিন এক জ্ঞাতি এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞাতিকে খাওয়ালে।

কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তাঁর বন্ধু

নাসিরুদ্দিন তাকেও মাংস খাওয়ালে।

এর পর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধু। নাসিরুদ্দিন তাকেও খাওয়ালে।

তারপর এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়ালে।

এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। আপনি কে?দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলে নাসিরুদ্দিন।

আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু

ভেতরে আসুন, বললে নাসিরুদ্দিন, খাবার তৈরিই আছে।

অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্লাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীসের মাংস মোল্লাসাহেব?

হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর, বললে নাসিরুদ্দিন।

আরও পড়ুন: তেনালি রামা’র গল্প – অপয়া রাময়া

3. বাহারি পোশাক

নাসিরুদ্দিন তার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের দেখা পেয়ে ভারী খুশি। বললে, বন্ধু, চলো পাড়া বেড়িয়ে আসি।

লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার এই মামুলি পোশাক চলবে না, বললে জামাল সাহেব। নাসিরুদ্দিন তাকে একটি বাহারি পোশাক ধার দিলে।

প্রথম বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন গৃহকর্তাকে বললে, ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু জামাল সাহেব। এঁর পোশাকটা আসলে আমার।

দেখা সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে জামাল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমার কেমনতরো আক্কেল হে! পোশাকটা যে তোমার সেটা কি না বললেই চলত না?

পরের বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, জামাল সাহেব আমার পুরনো বন্ধু। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটা কিন্তু ওঁর নিজেরই।

জামাল সাহেব আবার খাপ্পা। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, মিথ্যে কথাটা কে বলতে বলেছিল তোমায়?

কেন? বললে নাসিরুদ্দিন, তুমি যেমন চাইলে তেমনই তো বললাম।

না, বললেন জামালসাহেব, পোশাকের কথাটা না বললেই ভাল।

তিন নম্বর বাড়িতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন বললে, আমার পুরনো বন্ধু জামাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটার কথা অবিশ্যি না বলাই ভাল।

4. রুটির অর্থ – মোল্লা নাসিরুদ্দিন

নাসিরুদ্দিন নাকি বলে বেড়াচ্ছে যারা নিজেদের বিজ্ঞ বলে তারা আসলে কিচ্ছু জানে না। এই খবর শুনে সাতজন সেরা বিজ্ঞ নাসিরুদ্দিনকে রাজার কাছে ধরে এনে বললে, শাহেন শা, এই ব্যক্তি অতি দুর্জন। ইনি আমাদের বদনাম করে বেড়াচ্ছেন। এর শাস্তির ব্যবস্থা হোক।

রাজা নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কিছু বলার আছে?

আগে কাগজ কলম আনা হোক, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন।

কাগজ কলম এল।

এদের সাতজনকে একটি করে দেওয়া হোক।

তাও হল।

এবার সাতজনে আলাদা করে আমার প্রশ্নের জবাব লিখুন। প্রশ্ন হল-রুটির অর্থ কী?

সাত পণ্ডিত উত্তর লিখে রাজার হাতে কাগজ দিয়ে দিলেন, রাজা পর পর উত্তরগুলো পড়ে গেলেন।

পয়লা নম্বর লিখেছেন রুটি একপ্রকার খাদ্য।

দুই নম্বর–ময়দা ও জলের সংমিশ্রণে তৈয়ারি পদার্থকে বলে রুটি।

তিন নম্বর–রুটি ঈশ্বরের দান।

চার নম্বর–একপ্রকার পুষ্টিকর আহার্যকে বলে রুটি।

পাঁচ নম্বর–রুটির অর্থ করতে গেলে আগে জানা দরকার, কোনপ্রকার রুটির কথা বলা হচ্ছে।

ছয় নম্বর–রুটির অর্থ এক মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া সকলেই জানে।

সাত নম্বর–রুটির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।

উত্তর শুনে নাসিরুদ্দিন বললে, জাঁহাপনা, যে জিনিস এঁরা প্রতিদিন খাচ্ছেন, তার মানে এঁরা সাতজন সাতরকম করলেন, অথচ যে লোককে এঁরা কখনও চোখেই দেখেননি তাকে সকলে একবাক্যে নিন্দে করছেন। এক্ষেত্রে কে বিজ্ঞ কে মূর্খ সেটা আপনিই বিচার করুন।

রাজা নাসিরুদ্দিনকে বেকসুর খালাস দিলেন।

আরও পড়ুন: হাল ছেড়ে দাও বন্ধু! – সত্যই কি তাই?

5. চিনি খাওয়ার অভ্যেস

মোল্লা এখন কাজি, সে আদালতে বসে। একদিন এক বুড়ি তার কাছে এসে বললে, আমি বড়ই গরিব। আমার ছেলেকে নিয়ে বড় ফ্যাসাদে পড়েছি কাজিসাহেব। সে মুঠো মুঠো চিনি খায়, তাকে আর চিনি জুগিয়ে কুল পাচ্ছি না। আপনি হুকুম দিয়ে তার চিনি খাওয়া বন্ধ করুন। সে আমার কথা শোনে না।

মোল্লা একটু ভেবে বললে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এক হপ্তা পরে এসো, আমি একটু বিবেচনা করে তারপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।

বুড়ি হুকুমমতো এক হপ্তা পরে আবার এসে হাজির! মোল্লা তাকে দেখে মাথা নাড়লে।–এ বড় জটিল মামলা। আরও এক হপ্তা সময় দিতে হবে আমাকে।

আরও সাতদিন পরেও সেই একই কথা। অবশেষে ঠিক এক মাস পরে মোল্লা বুড়িকে বললে, কই, ডাকো তোমার ছেলেকে।

ছেলেটি আসতেই মোল্লা তাকে হুঙ্কার দিয়ে বললে, দিনে আধ ছটাকের বেশি চিনি খাওয়া চলবে না । যাও।

বুড়ি মোল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললে, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, কাজিসাহেব।

বলো।

এই নিয়ে চারবার ডাকলেন কেন আমাকে? এর অনেক আগেই তো আপনি এ হুকুম দিতে পারতেন।

তোমার ছেলেকে হুকুম দেবার আগে আমার নিজের চিনি খাওয়ার অভ্যেস কমাতে হবে তো! বললে নাসিরুদ্দিন।

6. আল্লা করেন তো

নাসিরুদ্দিনের ভারী শখ একটা নতুন জোব্বা বানাবে, তাই পয়সা জমিয়ে দরজির দোকানে গেল ফরমাশ দিতে। দরজি মাপ নিয়ে বললে, আল্লা করেন তো এক সপ্তাহ পরে আপনি জোব্বা পেয়ে যাবেন।

নাসিরুদ্দিন এক সপ্তাহ কোনওরকমে ধৈর্য ধরে তারপর আবার গেল দরজির দোকানে।

একটু অসুবিধা ছিল মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আল্লা করেন তো কাল আপনি অবশ্যই জোব্বা পেয়ে যাবেন।

পরদিন গিয়েও হতাশ। মাফ করবেন মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আর একটি দিন আমাকে সময় দিন। আল্লা করেন তো কাল সকালে নিশ্চয় রেডি পাবেন আপনার জোব্বা।

নাসিরুদ্দিন এবার বললে, আল্লা না করে তুমি করলে জোব্বাটা কবে পাব সেটা জানতে পারি কি?