‘ঈশপ’ নামটির সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানায় নিত্যপাঠ্য এই ঈশপের গল্প। ছোট ছোট গল্পে বিভিন্ন পশু পাখির বাস্তবিক রুপায়নে নীতিশাস্ত্রের পাঠ পড়াতে সফল এক গল্পকার ঈশপ। জীবনের নানা পর্যায়ে আমাদের বিভিন্ন রিপু দমনে ঈশপের গল্প এক ধরনের উপাত্ত হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের জীবনে কোনো ভুল কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সাহায্য করে।
ঈশপকে উপকথার জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। জনশ্রুতিই তার সম্পর্কে জানার একমাত্র ভরসা। সকলের কথাতে একটা দিক ভালভাবেই উঠে এসেছে যে, প্রজ্ঞা আর বুদ্ধিমত্তার জোরে হাস্যোদ্দীপক ও মজার গল্প বলে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন তিনি। সকলে তার কথা বলার ধরণ, অমায়িক ব্যবহার এবং গল্পের সারমর্ম শুনে তাকে খুব সহজেই ভালবেসে ফেলতেন।
মনে করা হয় যে, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের থ্রেস অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন যা বর্তমান গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই এশিয়া মাইনর উপকূলের নিকটবর্তী সামোস দ্বীপে দাসত্বজীবনে আবদ্ধ ছিলেন। প্রথম মনিব ছিলেন জানযুস এবং পরবর্তীতে লোডম্যানের দাসত্বে ছিলেন। দুই মনিবই ঈশপের উপর বেশ খুশি ছিলেন। ঈশপের গল্প বলার ভঙ্গি এবং দর্শন দেখে লোডম্যান তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন।
মুক্ত জীবন পেয়ে ঈশপ বিভিন্ন দেশ বিদেশে ঘুরতে লাগলেন। যেখানেই যান, সেখানেই গল্প বলার আসর জমিয়ে ফেলেন। এই গুণতো তার রক্তে মিশে আছে, এর থেকে মুক্তি কোথায়? তার মুখনিঃসৃত গল্প চারদিক ছড়িয়ে যেতে লাগল। অনেকেই ঈশপের গল্পের ভক্ত হতে লাগলো। তার নীতিশাস্ত্রগুলো মানুষের মনে আবেগের সঞ্চার করত।
ধীরে ধীরে ঈশপ লাইডিয়া নামক একটি নগর রাজ্যে পৌঁছলেন। ক্রোসাস ছিলেন সেখানকার রাজা। লোকমুখে ততদিনে রাজার কান পর্যন্ত চলে গিয়েছে ঈশপের কথা। তাই ঈশপকে দেখার আগ্রহ রাজার মনে বেশ ভালভাবেই তেঁতে উঠেছিল। ডাক পড়ল ঈশপের। ঈশপের সাথে কথা বলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজা। রাজার মাথায় তখন এক বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবলেন, ঈশপকে দিয়ে রাজ্যে নীতিবাক্য ছড়িয়ে দিবেন। লোকের মাঝে সমাজ সচেতনতা গড়ে তোলাটা যে খুব দরকার হয়ে পড়েছিল সেই সময়। ক্রোসাস তখন ঈশপকে নিজের সভাসদ হিসেবে নির্বাচিত করলেন। রাজসভায় বিভিন্ন নীতিবাক্যের গল্প বলে রাজাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলেন ঈশপ। দিনে দিনে রাজার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন তিনি। রাজ্যের বুড়ো থেকে বাচ্চারা ঈশপের কাছে গল্প শোনার জন্য অস্থির হয়ে যেত।
চতুর্দশ শতকে পাদ্রী প্লানুদেশ প্রথম ঈশপের গল্পের সংকলন প্রস্তুত করেন। অনেকগুলো গল্প একসাথে পুস্তকবন্দি হলো। এই পাদ্রীই প্রথম ঈশপের জীবনী রচনা করেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যাবিআসের লেখা ঈশপের একটি দুষ্প্রাপ্য সঙ্কলন মাউন্ট এথেসের মঠ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। ঈশপের নামে প্রচলিত লেখাগুলো মূলত সেখান থেকেই সংগৃহীত। ঈশপের গল্প দেশে দেশে এখনও সমান জনপ্রিয়।
ঈশপের গল্প মূলত একটা সমাজের বাস্তব সময়ের দর্পণস্বরূপ। সমাজের নানা ভুলগুলো এখনও হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে ঈশপের গল্পগুলো। আমাদের পাঠ্যপুস্তকের পড়ার ফাঁকে এইসব নীতিশাস্ত্র পর্যালোচনা করার অবকাশ আজকের সমাজে নেই বললেই চলে। কিন্তু সমাজকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হলে, সমাজের সকল অন্যায় অবিচার রুখতে হলে আমাদের নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ঈশপের গল্পের নীতিবাক্যগুলো যদি আমরা আমাদের পাঠ্যপুস্তকের সাথে সাথে জীবনের চলার পথে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি আর তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে এই কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।