শুধু বাংলায় নয়, সমকালীন ভারতের সবচেয়ে প্রবীণ সাহিত্যিকদের অন্যতম ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। গোটা দেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে সমসাময়িক কালে সবচেয়ে সম্মানিত নামগুলির অন্যতমও ছিলেন তিনি। জ্ঞানপীঠ, পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানও দিয়েছিল। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। পেয়েছিলেন ম্যাগসেসে পুরস্কারও।
১৯২৬ সালে জন্ম। পারিবারিক ভাবেই যোগ শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের জগতের সঙ্গে। প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং সাহিত্যিক মণীশ ঘটকের কন্যা মহাশ্বেতা দেবী। বিশ্বভারতীতে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হন। স্নাতকোত্তর পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মা ধরিত্রী দেবীও লেখক তথা সমাজকর্মী ছিলেন। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তবে ১৯৫৯ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিজন-মহাশ্বেতার পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যও ছিলেন নামী লেখক। তবে বিজন ভট্টাচার্য এবং নবারুণ ভট্টাচার্য মহাশ্বেতার আগেই প্রয়াত হয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবী ২৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যের প্রধানতম ক্ষেত্র ছিল আদিবাসী, দলিত ও নিপীড়িত জনগণ- যার এক বিরাট অংশ জুড়ে ছিল নারী। যারা নিজেদের অধিকারের জন্য বৃটিশের বিরুদ্ধে, ভারতের শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে ও উঁচুজাতের জোতদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে নিরন্তর বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রামে জড়িত। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের গ্রামাঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে বছরের পর বছর থেকেছেন, মিশেছেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রাম-আত্মবলিদান-সাহসী অধ্যবসায় প্রভৃতিকে গভীর উপলব্ধিতে ধারণ করেছেন। একে সাহিত্যে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন- তার গল্পের কাহিনী তিনি তৈরি করেননি- এগুলো জনগণেরই জীবন এবং তাদেরই সৃষ্টি। আদিবাসীদের জীবন ও সংগ্রামকে ঘিরে তার এমনি এক অসাধারণ উপন্যাস “চোট্টিমুন্ডা ও তার তীর”।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি অধ্যাপনা এবং সামাজিক আন্দোলনও চালিয়ে গিয়েছেন সমান তালে। অনগ্রসর শ্রেণির জন্য তাঁর লড়াই চিরস্মরণীয়। আদিবাসীদের মধ্যে, বিশেষ করে লোধা ও শবরদের মধ্যে মহাশ্বেতা দেবীর কাজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় করে নিয়েছে। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘তিতুমির’, ‘হাজার চুরাশির মা’ সহ তাঁর একাধিক সৃষ্টি চিরন্তন হয়ে গিয়েছে বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে। তাঁর একাধিক রচনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন পুরস্কার জয়ী ছবি।