প্রকৃত বন্ধুত্ব : সুন্দর একটি চৈনিক উপকথা

প্রকৃত বন্ধুত্ব: সুন্দর একটি চৈনিক উপকথা

প্রকৃত বন্ধুত্ব – এই গল্পটি চীন দেশের সুন্দর একটি উপকথা।

অনেক, অনেক বছর আগে চিন দেশে লে গুয়াং আর কুয়াফু নামে দুই বন্ধু থাকত। এই দুজন অল্পবয়েসি মানুষ পরস্পরকে খুব ভালোবাসত এবং সবসময়ে একসঙ্গে থাকত। তারা কেউ কাউকে খারাপ কথা বলত না; কোনো কু-চিন্তা তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারেনি। তাদের এই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আর পরিরা তাদের এই গুণের জন্য কীভাবে তাদের সত্যিকারের পুরস্কার দিয়েছিল। তাদের ভালোবাসা কতটা জোরদার ছিল সেটা এই গল্পটা শোনালেই বোঝা যাবে।

বসন্তের গোড়ায় একটা সুন্দর ঝলমলে দিনে শহরের ক্লান্তিকর, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে একটু মুক্তির আশায় লে গুয়াং আর কুয়াফু একসঙ্গে হাঁটতে বেরোল।

লে গুয়াং আপনমনে বলল “চলো, পাইনের জঙ্গলের একদম গভীরে যাওয়া যাক।” ওখানে আমরা সমস্ত চিৎকার চেঁচামেচি ভুলে থাকতে পারব; ওখানে আমরা ফুলের সুন্দর গন্ধও বুক ভরে নিতে পারব আর শ্যাওলায় ঢাকা মাটিতে শুয়ে থাকতে পারব।”

“বাঃ!” বলল, কুয়াফু,”আমিও ক্লান্ত। জঙ্গলই বিশ্রাম নেওয়ার উপযুক্ত জায়গা।”

বেশ একটা ছুটির দিনে, দূরের গাছগুলোর মাথার দিকে চোখ রেখে দুই পরম বন্ধু আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। তারা যতই বনের কাছে আসতে লাগল, ভাল সময় কাটানোর উত্তেজনায় তাদের হৃৎস্পন্দন যেন তত দ্রুত হতে লাগল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লে গুয়াং বলল “গত এক মাস ধরে আমি প্রচণ্ড পড়াশোনা করেছি। এই তিরিশ দিন আমি কোনো বিশ্রাম পাইনি। আমার মাথার মধ্যে এত এখন এত কিছু গিজগিজ করছে যে, মনে হচ্ছে, মাথাটা বোধ হয় ফেটেই যাবে। উফ, সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া টাটকা বাতাস বুক ভরে নেব।”

“আর আমি” দুঃখের সঙ্গে বলল কুয়াফু,”ক্রীতদাসের মতো আমার মালিকের দোকানে কাজ করেছি। তোমার লেখাপড়ার কাজটার মতোই আমার কাজটাও খুব একঘেয়ে। মালিক আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেন। তাঁর হাতের নাগালের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারাটা সত্যিই খুব ভালো ব্যাপার।”

আরও পড়ুন: চু কোই ও বট গাছের গল্প – ভিয়েতনামের একটি সুন্দর রূপকথা

কথা বলতে বলতে তারা ছোট জঙ্গলটার প্রায় সীমানায় চলে এল, একটা ছোট নদী পেরোল আর তারপর সামনের লম্বা লম্বা গাছ আর ঘন ঝোপের মধ্যে যেন হারিয়ে গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা তারা এদিক-ওদিক এলোমেলো ঘুরে বেড়াল, গল্প করল, মজার গল্প করে হাসতে লাগল। হঠাৎ এক সময় রাশি রাশি ফুলে ঢাকা ঝোপ পেরোতে গিয়ে তারা দেখতে পেল, তাদের সামনেই রাস্তাটার ওপর একটা সোনালি আপেলের মত কি যেন চকচক করছে।

“দেখো! দেখো!” অপেলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল।

তাদের নাক বরাবর রাস্তার ওপর একটা আপেল সোনার মত চকচক করছে।

লে গুয়াং ঝুঁকে সোনার অপেলটা কুড়োল। সেটা প্রায় একটা আপেলের মতো বড়ো আর সূর্যের আলোয় ঝলমল করছিল। তার গায়ে ছিল খুব সুন্দর কারুকার্য করা। “বন্ধু, এটা তোমার” বলে কুয়াফুর হাতে সেটা দিয়ে সে বলল “তোমার, কারণ তুমিই এটা প্রথম দেখতে পেয়েছ।”

কুয়াফু অমনি বলে উঠল,”না, না, তুমি ভুল করছ ভাই, তুমিই তো প্রথম বললে। এখন তুমি আর বলতে পারবে না যে, মন দিয়ে পড়াশোনা করার জন্য পরিরা তোমাকে কোনো পুরস্কার দেয়নি।”

“আমার পড়াশোনার পুরস্কার! কেন? হতেই পারে না। জ্ঞানী মানুষরা কি সবসময় বলেন না, যে, পড়াশোনা করলে আপনাআপনিই তার পুরস্কার পাওয়া যায়? না ভাই, এই সোনাটা তোমার; আমি বলছি, তোমার। দিনের পর দিন যে তুমি কঠিন পরিশ্রম করেছ সে কথাটা একবার ভাবো— খাটিয়ে খাটিয়ে মালিক তোমার হাড়মাস কালি করে দিল! তার চেয়ে এটা অনেক ভালো। নাও” এই বলে সে হাসতে লাগল। “এটা সেই লক্ষ্মীর ঝাঁপি হতেও তো পারে যা দিয়ে তুমি তোমার ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।”

তারা এভাবেই কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করল, দুজনেই সেই দামি জিনিষটা নিজের কাছে নিতে অস্বীকার করল। এ ওকে আর ও একে জিনিসটা নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। শেষমেষ, যেখানে তারা সোনার টুকরোটা প্রথম দেখেছিল সেখানেই সেটা পড়ে রইল আর দুই বন্ধু চলে গেল। সোনার টুকরোটাকে ফেলে যাওয়ার জন্য তাদের একটুও দুঃখ ছিল না, কারণ এই জগতে অন্য কোনো কিছুর চেয়ে তাদের কাছে তাদের বন্ধুত্ব অনেক দামি ছিল। আর তাই কোনোরকম ঝগড়াঝাঁটিও তাদের কাছ ঘেঁষতে পারেনি।

“আমরা কিন্তু সোনা পাব বলে শহর ছাড়িনি” লে গুয়াং মন থেকে বলল।

“না” তার বন্ধু উত্তর দিল,”এই জঙ্গলে একটা দিন কাটানোটা হাজার হাজার সোনার টুকরোর সমান।”

লে গুয়াং প্রস্তাব দিল,”চলো, ঝরনাটার কাছটায় যাই, পাথরের ওপর একটু বসি। গোটা বনটার মধ্যে এই জায়গাটাই সবচেয়ে ঠান্ডা।”

তারা যখন ঝরনাটার কাছে পৌঁছোল, দুঃখের সঙ্গে দেখল যে জায়গাটা ইতিমধ্যেই দখল হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে আসা একটা লোক মাটির ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।

কুয়াফু চেঁচিয়ে বলল,”এই যে হে, উঠে পড়ো! খুব কাছেই তোমার জন্য ধনসম্পদ পড়ে আছে। ওইখানে রাস্তার ওপর একটা সোনার আপেল অপেক্ষা করছে, কখন কে গিয়ে তাকে তুলে নেবে।”

তারপর তারা সেই অবাঞ্ছিত আগন্তুককে বুঝিয়ে দিল ঠিক কোনখানটায় সোনার টুকরোটা ছিল। আর সেকথা শুনে লোকটাও ছুটল সেই দিকে। তাই না দেখে দুই বন্ধু খুব মজা পেল।

প্রায় ঘণ্টা খানেক তারা একে অন্যের সঙ্গে আনন্দে কাটাল, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার কথা আলোচনা করল, মাথার ওপর ডাল থেকে ডালে উড়ে যাওয়া পাখিদের গান শুনল।

আরও পড়ুন: পুরাণের গল্প – জেনে নেওয়া যাক, পুরাণ কয়টি বা কিই বা আছে তাতে

অনেকক্ষণ পরে তারা একটা রাগী গলার আওয়াজে চমকে গেল। এটা সেই লোকটারই গলা, যে সোনার টুকরোটা কুড়োতে গিয়েছিল। “বাবুরা, আমাকে নিয়ে এমন মস্করা তোমরা কেন করলে? এমন গরমের দিনে আমার মতো একটা গরিব মানুষকে কেন মিছিমিছি দৌড় করালে?”

“কী বলছ, হে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল লে গুয়াং। “আমরা তোমাকে যে ফলটার কথা বললাম সেটা খুঁজে পাওনি?”

রাগ-চাপা গলায় সে বলল,”না। কিন্তু তার জায়গায় ছিল একটা রাক্ষুসে সাপ, আমার তলোয়ারটা দিয়ে আমি যেটা দু-টুকরো করে ফেলেছি। ভগবান এবার বনের প্রাণী মেরে ফেলার জন্য আমায় অভিশাপ দেবেন। তোমরা যদি ভেবে থাক যে ওরকম একটা কৌশল করে তোমরা আমাকে এখান থেকে তাড়াবে, তাহলে তোমরা ভুল ভেবেছ, কারণ আমি এখানে আগে এসেছি; আমাকে ভুল কথা বলে এখান থেকে সরানোর অধিকার তোমাদের কে দিল বাবুরা?”

“এই যে হে, বকবক থামাও। তোমার হয়রানির জন্য একটা পয়সা নাও। আমরা ভেবেছিলাম আমরা তোমার একটা উপকার করলাম। এখন, তুমি যদি অন্ধ হও, সেজন্য একমাত্র তুমিই দায়ী। কুয়াফু, চলো আমরা ফিরে যাই। সোনার আপেলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই আজব সাপটার দিকে একবার দেখি।”

গ্রাম থেকে আসা লোকটাকে ফেলে রেখে তারা দুই বন্ধু গল্পগুজব করতে করতে সেই সোনার টুকরোটার খোঁজে চলে গেল।

“আমি যদি ভুল না করি,” ছাত্রটি বলল, “ওই যে গাছটা কেটে রাখা আছে, তার পেছনে সোনাটা আছে।”

“একদম ঠিক; খুব শিগগিরি আমরা মরা সাপটা দেখতে পাব।”

মাটির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে তাড়াতাড়ি তারা বাকি রাস্তাটা পেরোল। যেখানে তারা সেই চকচকে অপেলটা ফেলে রেখে গিয়েছিল সেই জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে তারা দেখল, একটা সোনার আপেল নয়, ভবঘুরের বর্ণনা মতো কোনো মরা সাপও নয়, তার বদলে দুটো সুন্দর সোনার আপেল, প্রত্যেকটা, তারা প্রথমে যেটা দেখেছিল তার থেকে আকারে বড়ো। দুজনেই একটা করে আপেল তুলে নিল আর আনন্দের সঙ্গে বন্ধুর হাতে দিল।

“শেষ পর্যন্ত পরি’রা তোমাকে তোমার স্বার্থহীনতার পুরস্কার দিল!” বলল লে গুয়াং।

“হ্যাঁ,” উত্তর দিল কুয়াফু,”তোমাকে তোমার প্রাপ্যটা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে।”

এটি একটি চৈনিক উপকথা থেকে নেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top