প্যারীচাঁদ মিত্র : বাংলায় প্রথম ঔপন্যাসিক
প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম একটি স্তম্ভ। একজন ভাষাবিদ্রোহী, নিবেদিত সমাজকর্মী, নিষ্ঠাবান সংগঠক, নব আকাঙ্ক্ষালব্ধ সাহিত্যিক এবং নির্ভীক সাংবাদিক ছাড়াও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক।
প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮১৪ সালের ২২শে জুলাই কলকাতার এক বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। প্যারীচাঁদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে। শৈশবে একজন গুরুমহাশয়ের নিকট বাংলা, পরে একজন মুন্সির নিকট ফারসি শিখেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে। শৈশবে একজন গুরুমহাশয়ের নিকট বাংলা, পরে একজন মুন্সির নিকট ফারসি শিখেন। ইংরেজি শিক্ষা লাভের জন্য ১৮২৭ সালে তিনি হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন।
ঐ সময় ভিভিয়ান ডিরোজিও, বাংলার নব জাগরণের হোতা, ছিলেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক। প্যারীচাঁদ তার শিষ্য ও ভাবশিষ্য ছিলেন। তিনি মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী ছিলেন রাধানাথ শিকদার। প্যারীচাঁদ মিত্র দি ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া এবং বেঙ্গল সেপক্টেটর পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তিনি পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সফল হয়েছিলেন।
১৮৩৬-এ কলকাতায় শুরু হয় ‘দ্য ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’ এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয় এই লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে । ১৮৪৮ সালে প্যারীচাঁদই হলেন পাবলিক লাইব্রেরির প্রধান গ্রন্থাগারিক, কিউরেটরও— মাইনে একশো টাকা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, ‘তিনি এত মিশুক ছিলেন ও তাঁহার পড়াশুনা এত বেশী ছিল যে, কি ইংরাজ, কি বাঙ্গালী, যাঁহার যখন কিছু জানিবার দরকার হইত, মেটকাফ হলে লাইব্রেরিতে গিয়া উপস্থিত হইতেন এবং তিনি তাঁহার সাধ্যমত তাঁহাদের উপকার করিতে চেষ্টা করিতেন। মেটকাফ হল তখন বড় রকম একটী পণ্ডিতের আড্ডা হইয়াছিল।’ ১৮৬৬ সালে বৈতনিক পদ ত্যাগ করার পরেও সুদক্ষ, বিদগ্ধ মানুষটিকে ছাড়েননি কর্তৃপক্ষ। প্যারীচাঁদ এর পরে ছিলেন অবৈতনিক সেক্রেটারি, লাইব্রেরিয়ান ও কিউরেটর, সব পদেই! কালক্রমে সেই লাইব্রেরি ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’, স্বাধীনতার পরে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ হয়েছে।
আরও পড়ুন: রাজা রামমোহন রায় – বাঙলার নবজাগরণের পুরোধা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, ‘বাঙ্গালী সমাজের কোনও বিপদ সম্পদ্ উপস্থিত হইলে, একটা বড় রকম আন্দোলন উপস্থিত হইলে, প্যারীচাঁদ মহাশয় তাহাতে একহাত আছেনই আছেন। কিন্তু কোথাও… প্রধান (অগ্রণী, নেতা) হইবার চেষ্টা করিতেন না। ইংরাজীতে তাঁহার কলম খুব চলিত। সভাসমিতির কাজকর্ম্ম ইংরাজীতেই হইত; সুতরাং প্যারীচাঁদ ভিন্ন চলিত না। তিনিও ইচ্ছা করিয়া ধরা দিতেন এবং খুব খাটিয়া কাজ উদ্ধার করিয়া দিতেন।’ উনিশ শতকের কলকাতায় এমন কোনও সক্রিয় সংস্থা ছিল না, প্যারীচাঁদ যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন না।
লেখক বন্ধু রাধানাথ সিকদারের একান্ত অনুরোধে প্যারিচাঁদ মিত্র খুব সহজ সরল ভাষায় এ কাহিনিটি লেখা শুরু করেন। তখন যে কয়টি বাংলা পত্রিকা ছিল সব পত্রিকাগুলো রাশভারী লিখার পিছনে দৌড়াত। সহজ সরল বাংলা ভাষায় কোন লিখা তারা সহজে ছাপাতে রাজী হতো না। বন্ধু রাধানাথ সিকদার ও প্যারীচাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় বের হয় ‘মাসিক পত্রিকা’। এই পত্রিকায় তিনি ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে লিখা শুরু করেন- ‘আলালের ঘরের দুলাল’। বইটিতে মোট ত্রিশটি পরিচ্ছদের মধ্যে সাতাশটি পরিচ্ছদ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রথমেই আস্ত বই হয়ে বেরোয়নি। আগে পত্রিকায় মুখ দেখিয়েছে ধারাবাহিক ভাবে। সেই ‘মাসিক পত্রিকা’ও প্যারীচাঁদেরই গড়া, বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সঙ্গে মিলে, শুরু ১৮৫৪-র অগস্ট থেকে। পত্রিকার উপরের পাতায় লেখা, ‘এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষতঃ স্ত্রীলোকদের জন্যে ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্ত্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।’ স্পষ্ট বলে দেওয়া ।
তিনি লিখেছেন আরো সতেরোটি গ্রন্থ; কিন্তু এই একটি বই-ই বাঙালির কাছে তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। নানামাত্রিক বিতর্ক থাকলেও আলালের ঘরের দুলালকেই বলা হয় বাংলাসাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যের প্রধান সব সমালোচকই আলালের ঘরের দুলালকে, সব সীমাবদ্ধতা আমলে নিয়েই, বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: কলকাতার আড্ডার বিবর্তন বৈঠকখানা থেকে ক্যাফে বা কফি শপ
‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে বিশেষত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কোলকাতা ও তাঁর নগর কেন্দ্রিক সামাজিক চিত্র আশ্চর্য নিপুণতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। নব্য শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের কার্যকলাপ ও পরিণতি গ্রন্থটির মূল উপপাদ্য বিষয়। তিনি তখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন যে, ধর্ম ও নীতি হীনতায় উচ্ছৃঙ্খলতার মূল কারণ। শুধুমাত্র জীবনযাত্রার প্রণালীর মধ্যেই রয়েছে এ মরণ দশা থেকে উত্তরণের উপায় ও মুক্তির পথ। নকশার রীতি এই কাহিনির উপর যতটা না প্রভাব ফেলেছে তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে কাহিনির ধারাবাহিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বাস্তব চিত্রাঙ্কন।
১৮৮৩ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্যারীচাঁদ মিত্র একাধিক কারণে বর্তমান কালেও সবার কাছে প্রাসঙ্গিক। সমকালীন জীবন ও চলিত ভাষাকে লিখনে নিয়ে আসার দুঃসাহসিক দৃষ্টান্ত প্রথম তিনিই বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করেছিলেন।
Picture credit: anandabazar.com