পৃথিবীর কয়েকটি অনন্য ও অদ্ভুত মরুভূমি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক

‘মরুভূমি’ নাম শুনলেই যেন তাদের শুষ্ক ভূপ্রকৃতি এবং সঙ্গত কারণেই চরম অবস্থার কোথায় কেবল মনে আসে। তবে পৃথিবীতে কিছু অদ্ভুত মরুভূমি রয়েছে যাদের বৈশিষ্ঠ অনন্য ও রহস্যময় মনে হয়। যেমন ব্রাজিলের “ফ্লাডেড ডেজার্ট” বা বলিভিয়ার ইথারিয়াল লবণের ফ্ল্যাট ইত্যাদি প্রতিটি মরুভূমি ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়। আমরা এখানে কয়েকটি ‘অনন্য এবং রহস্যময় মরুভূমি’ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব যেখানে প্রকৃতির রহস্যময় শক্তিগুলি এমন ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করেছে যা আমাদের বিস্ময়ের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

আরল মরুভূমি : এক পরিবেশগত বিপর্যয়ের করুণ ফলশ্রুতি

আরল মরুভূমি
Picture source: euronews.com

আরল মরুভূমি আসলে মধ্য এশিয়ার বুকে গড়ে ওঠা এক পরিবেশগত বিপর্যয়ের করুণ কাহিনি। যেখানে একসময় ছিল বিশাল আরল সাগরের জলরাশি, আজ সেখানে শুধুই শুষ্ক মরুভূমির প্রাধান্য। কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মধ্যবর্তী এই এলাকা প্রকৃতির উপর মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপের এক চূড়ান্ত নিদর্শন।

একসময় আরল সাগর ছিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ। এর জলভাণ্ডার স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্বাহে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে শুরু হওয়া বিশাল সেচ প্রকল্পের কারণে এর দুটি প্রধান নদী, আমু দরিয়া এবং সির দরিয়া, ভিন্ন পথে মোড় নেওয়া হয়। এর ফলে আরাল সাগরের জল দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে।

আরল মরুভূমি

জল হারিয়ে যাওয়ার পর সাগরের তলদেশটি এক বিরাট শূন্য মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়, যা এখন আরাল মরুভূমি নামে পরিচিত। এই মরুভূমি থেকে ওঠা ধুলিকণাগুলি বিষাক্ত লবণ, কীটনাশক, এবং রাসায়নিক পদার্থে পূর্ণ। ফলে আশেপাশের অঞ্চলে মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। জমিগুলির উর্বরতা হারিয়েছে, জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি মাছ ধরার শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে হাজারো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

আরাল সাগরের কিছু অংশ পুনরুদ্ধারের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কক-আরাল বাঁধ নির্মাণ একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই বাঁধের সাহায্যে সাগরের উত্তর অংশে জল ফিরিয়ে আনার কিছুটা সাফল্য পাওয়া গেছে এবং জীববৈচিত্র্যের আংশিক পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। তবে আরাল সাগরের ক্ষতির বেশিরভাগ অংশই স্থায়ী এবং অপূরণীয়।

আরাল মরুভূমি কেবল একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাহিনি নয়, এটি মানব সভ্যতার ভুল পরিকল্পনার ভয়াবহ পরিণতিরও উদাহরণ। এই ঘটনা আমাদের শিখিয়ে দেয় যে প্রকৃতির সঙ্গে অসতর্ক আচরণের পরিণতি কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় এড়ানোর জন্য দায়িত্বশীল ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

এই ঘটনা আমাদের প্রকৃতির প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়ার এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সচেষ্ট হওয়ার বার্তা দেয়।

আরও পড়ুন: অনুপ্রেরণামূলক বা শিক্ষামূলক বাছাই করা 10টি গল্প

বানভাসি মরুভূমি বা Flooded desert : প্রকৃতির এক অদ্ভুত মরুভূমি

বানভাসি মরুভূমি
Picture credit: whenonearth.net

উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের মারানহাও রাজ্যে অবস্থিত লেনসয়েস মারেনহেনসিস জাতীয় উদ্যান সত্যিই একটা অবাক করা জায়গা। এখানে প্রায় ১০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে শুধু সাদা মসৃণ বালি, আর তার মাঝখানে হালকা নীলচে রঙের ছোট ছোট হ্রদ। দেখে মনে হয় মরুভূমি তবে অনেকের বলেন এটা মরুভূমি নয়!

এই বানভাসি মরুভূমি আমাজন বেসিনের খুব কাছে, আর বছরের শুরুতে এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির জল জমে বালির টিলাগুলোর মাঝে গর্তে তৈরি হয় সুন্দর নীল-সবুজ লেগুন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এই লেগুনগুলো থাকে একেবারে ভরপুর। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, এই লেগুনগুলোতে মাছও পাওয়া যায়। শুষ্ক মৌসুমে লেগুন শুকিয়ে গেলেও ডিম থেকে আবার মাছ জন্ম নেয়।

পার্কটিতে শুধু বালি আর লেগুন নয়, আছে ম্যানগ্রোভ গাছ, নির্জন সমুদ্রতট, সুন্দর পাম গাছ এবং প্রিগুইকাস নদী। সব মিলিয়ে জায়গাটা একেবারে ছবির মতো।

লেনসয়েস মারেনহেনসিস
Picture credit: whenonearth.net

লেনসয়েস মারেনহেনসিস তৈরি হতে লেগেছে হাজার হাজার বছর। নদীর তলদেশ থেকে বালি উঠে আসে, আর বাতাস ও সমুদ্রের ঢেউ সেগুলো টেনে নিয়ে আসে ভেতরের দিকে। ফলে বালির টিলাগুলো প্রায় ৩১ মাইল ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং ২৭ মাইল পর্যন্ত উপকূল বরাবর বিস্তৃত।

এই জাতীয় উদ্যানের কিছু লেগুন বেশ বড়। যেমন, লাগোয়া বনিতা এবং লাগোয়া আজুল, যেগুলো বারিরিনহাস শহরের কাছে। আর লাগোয়া দা গাইভোটা, যেটা অন্যতম সুন্দর এবং বড়, সান্তো আমারো দো মারানহাওর কাছে অবস্থিত।

এই পার্ক ঘুরতে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো মে থেকে সেপ্টেম্বর। তখন লেগুনগুলো জল ভরতি থাকে, আর আকাশও থাকে একেবারে ঝকঝকে। তাই যদি সুযোগ পান, এই অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটা একবার দেখে আসতে ভুলবেন না।

কারক্রস মরুভূমি (Carcross desert ): বিস্ময়কর ছোট্ট মরুভূমি

কারক্রস মরুভূমি
Picture credit: dailypassport.com

কানাডার ইউকন টেরিটরিতে অবস্থিত কারক্রস মরুভূমি একটি ছোট্ট অথচ বিস্ময়কর জায়গা। জানো কি, এটি মাত্র ১ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত? আকারে ছোট হলেও, এটাই একে আকর্ষণীয় করে তুলেছে! অনেকে একে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মরুভূমি বলেন, আবার কেউ কেউ বলেন, এটি উত্তরতম মরুভূমি।

তবে মজার বিষয় হলো, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন কারক্রস মরুভূমি আসলে মরুভূমি নয়, কারণ এখানকার মাটি বেশ আর্দ্র। তা সত্ত্বেও, একসময় এটি প্লাইস্টোসিন যুগের হিমবাহের হ্রদ ছিল বলে জানা যায়। আশেপাশের পাহাড়ের বৃষ্টি-ছায়ার কারণে জায়গাটি বেশ শুকনো থাকে।

এখানকার তীব্র বাতাস বেশিরভাগ উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা কঠিন করে তোলে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, কারক্রস মরুভূমিতে কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখা যায়। যেমন, ইউকন লুপিন ফুল আর ডাল প্রজাতির ভেড়া! এটি কি কৌতূহল উদ্রেক করে না?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top