দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্র ও দেশপ্রেমিক

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
Picture credit: anandabazar.com

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডিএল রায়) জন্মেছিলেন ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই, কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র এবং প্রসন্নময়ী দেবীর সপ্তম সন্তান হিসেবে। তাঁর ঠাকুর্দা মদনগোপাল রায় ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাপতি। তাঁর পরিবারের পরিবেশ ছিল সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত।

শৈশবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

শৈশবেই গানের প্রতি আকর্ষণ জন্মে দ্বিজেন্দ্রলালের। মাত্র ছয়-সাত বছর বয়সে হারমোনিয়াম বাজানো শিখে ফেলেন। নয় বছর বয়সে তিনি প্রথম গান লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘আর্যগাথা’ প্রকাশিত হয় মাত্র ১৯ বছর বয়সে।

দ্বিজেন্দ্রলালের বয়স যখন পাঁচ বছর। পিতা কার্তিক চন্দ্র রায় ছিলেন একজন সুগায়ক। একদিন তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে খেয়াল গান গাইছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল একমনে শুনছে।

গাইতে গাইতে পিতা কি একটা কাজে হঠাত্ উঠে গেলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল সেই অবসরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলো এবং চাবি টিপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে কার্তিক চন্দ্র ফিরে এসে শিশু পুত্রের কান্ড দেখে অবাক। ছেলে তার গাওয়া কঠিন গানটি ঠিক ভাবে শুরু করে গাইছে।

৭ কি ৮ বছর বয়সে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একজনের অনুকরণে বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল সে। আর কি সুন্দর আবৃত্তি করতে পারত। একবার পড়েই গড়গড় করে তা বলে যেত।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় এক অবাক কান্ড ঘটল। একদিন ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্র পড়া তৈরি করে আসেনি। তাই শিক্ষক মহাশয় তাদের বললেন- “তোমরা সব ঘরের ধারে দাঁড়িয়ে পড়া মুখস্ত কর”। ছাত্ররা তাই করতে লাগল।

খানিক পরে তিনি দ্বিজেন্দ্রলালের দিকে তাকিয়ে বললেন-“তুমি কি করছো? ও, তোমার বই নেই? তাহলে কি করে পড়বে?”

দ্বিজেন্দ্র বলল-“আমার পড়া মুখস্থ হয়ে গেছে”।

শিক্ষক মহাশয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- “কিভাবে?”

দ্বিজেন্দ্র জবাব দিল-“ওদের পড়া শুনে শুনে”

শিক্ষক মহাশয় পরীক্ষা করে দেখলেন সত্যিই তাই অন্য ছেলেদের পড়াশোনা মুখস্থ হয়ে গেছে অথচ সেই সব ছাত্র দের কেউ বই দেখে পড়া মুখস্ত করতে পারেনি।

আরও পড়ুন: প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ – ভারতবর্ষে রাশিবিঞ্জানের জনক

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কর্ম জীবন

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পড়াশোনায়ও ছিলেন কৃতী। প্রবেশিকা, এফএ, বিএ এবং এমএ পাস করার পর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য ইংল্যান্ড যান। সেখানে কৃষিবিদ্যায় বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ জন্মায়।

দেশে ফিরে তিনি সমাজের রীতি ভাঙার সাহস দেখান। বিলেতে যাওয়া নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করেন। কৃষকদের সহায়তায়ও তিনি ছিলেন অগ্রণী। সরকারি কাজে তিনি কৃষকদের খাজনা কমিয়ে দিয়েছিলেন, যার জন্য তাঁকে ‘দয়াল রায়’ নামে ডাকত তারা।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি রচনা করেছিলেন প্রায় ৫০০টি গান, যা দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তাঁর কালজয়ী নাটকগুলোর মধ্যে ‘রানা প্রতাপসিংহ’, ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘নূরজাহান’ অন্যতম। এই নাটকগুলিতে দেশাত্মবোধক গান সংযোজন করে তিনি বাঙালির মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করেছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলির মধ্যে ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ এবং ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ আজও স্মরণীয়।

তিনি ‘পূর্ণিমা মিলন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্কদের মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল।

১৯১৩ সালের ১৭ মে, মাত্র ৫০ বছর বয়সে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চিরবিদায় নেন। তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীতের অবদান বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং আজও অনুপ্রেরণার উৎস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top