জাকা তারুব ও দেবকন্যা গল্পটি ইন্দোনেশিয়ার একটি বিখ্যাত লোককাহিনী। একজন পুরুষ ও তার দেবদূত স্ত্রীর গল্প। বেশিরভাগ জাভানিজ মানুষ এই গল্পটি মাধ্যমে যেকোনো মানুষ এমনকি তাদের প্রিয়জনদের কাছে মিথ্যা বলা এড়াতে স্মরণ করিয়ে দেয়।

জাকা তারুব ও দেবকন্যা – ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলের লোকগাথা
অনেকদিন আগের কথা, একবার এক যুবক ছিল, তার নাম ছিল জাকা তারুব। সে ছিল এক সাধাসিধে মানুষ, প্রকৃতির সৌন্দর্যে মোহিত হতে ভালোবাসত। একদিন সে বনের পথ ধরে চলছিল। হঠাৎ সে এক হ্রদের ধারে এসে দাঁড়ায়। সে শুনতে পায় মিষ্টি হাসির শব্দ, যেন কেউ বা করা জলকেলি করছে।
কৌতূহলবশত সে লুকিয়ে দেখল—সাতজন অপরূপ সুন্দরী নারী হ্রদের জলে আনন্দে মগ্ন! তারা হাসছে, কৌতুক করছে, খেলছে। জাকা তারুব তাদের অপূর্ব সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে গেল। একটু ভালো করে দেখতেই সে বুঝল—এরা কোনো সাধারণ নারী নয়, দেবকন্যা!
অজানা আকর্ষণে সে চুপিচুপি একটি দেবকন্যার ওড়না বা “শাল” তুলে নিল, যা তাদের স্বর্গে ফেরার একমাত্র মাধ্যম ছিল। কিছুক্ষণ পর, দেবকন্যারা জল থেকে উঠে আসতে লাগল। সবাই তাদের শাল পরে একে একে আকাশে উড়ে চলল। কিন্তু একজন দেখতে পেল তার শাল নেই!
সে বড়ই বিপদে পড়ল। তার ছয় বোন অনেক খুঁজেও শালটি পেল না। আকাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। নিরুপায় হয়ে তার বোনেরা তাকে একা ফেলে স্বর্গে ফিরে গেল। অসহায় দেবকন্যা বসে কাঁদতে লাগল।
এমন সময় জাকা তারুব এগিয়ে এসে দুঃখভরা মুখে বলল, “তুমি কেঁদো না, আমি তোমার সাহায্য করতে পারি।” তিনি দেবকন্যাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রেমের বন্ধন গড়ে উঠল। কিছুদিন পর তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো।
দেবকন্যার নাম ছিল নাওয়াং উলান। বিয়ের পর তারা সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগল। তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিল এক কন্যাসন্তান, যার নাম রাখা হলো নাওয়াংসিহ।
কিন্তু নাওয়াং উলানের একটি রহস্য ছিল। তিনি রান্নার জন্য প্রতিদিন মাত্র একটি ধানের দানা ব্যবহার করতেন, যা দিয়ে এক হাঁড়ি ভাত তৈরি হয়ে যেত! তবে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, জাকা তারুব কখনোই তার রান্নার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।
আরও পড়ুন: আসল বন্ধুত্ব – সুন্দর একটি চৈনিক উপকথা
কিন্তু কৌতূহলী জাকা তারুব একদিন লুকিয়ে দেখে নিল তার রান্নার রহস্য। সে দেখতে পেল হাঁড়ির ভেতর সত্যিই মাত্র একটি ধানের দানা রয়েছে! পরদিন থেকে নাওয়াং উলানের সেই অলৌকিক শক্তি হারিয়ে গেল। এখন তাকে সাধারণ নারীদের মতো ধান কুটতে এবং চালে রূপান্তর করতে হলো।
এরপর ধীরে ধীরে তাদের ঘরের ধানের ভান্ডার কমতে লাগল। একদিন, ধানঘরে চাল খুঁজতে গিয়ে নাওয়াং উলান হঠাৎই তার সেই হারিয়ে যাওয়া শালটি খুঁজে পেল! সে বুঝতে পারল, এতদিন তার স্বামীই ওড়নাটি লুকিয়ে রেখেছিল।
ক্রোধে ও কষ্টে নাওয়াং উলান আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকতে চাইল না। সে জাকা তারুবকে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ! আমি আর তোমার সঙ্গে থাকতে পারব না।”
জাকা তারুব কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইতে লাগল, অনুরোধ করল তাকে ছেড়ে না যেতে। কিন্তু নাওয়াং উলানের মন নরম হলো না।
তবে তিনি একটি শর্ত দিলেন—তিনি মাঝে মাঝে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, শুধু তার কন্যা নাওয়াংসিহকে দুধ খাওয়ানোর জন্য। তবে সে এলে, জাকা তারুব তার সামনে থাকতে পারবে না। তাকে একা কন্যার কাছে রেখে যেতে হবে।
বিধ্বস্ত জাকা তারুব তার শাস্তি মেনে নিল। চোখের সামনে তার প্রিয় স্ত্রী আকাশে উড়ে স্বর্গে ফিরে গেল।
তবে প্রতিশ্রুতি অনুসারে, মাঝে মাঝে নাওয়াং উলান পৃথিবীতে ফিরে আসত, কন্যাকে কোলে নিয়ে স্নেহ করত। কিন্তু জাকা তারুবের কাছে সে আর কখনোই ফিরে আসেনি।
এটি ছিল জাকা তারুব ও দেবকন্যা নাওয়াং উলানের মর্মস্পর্শী কাহিনি, যা বলে— মিথ্যা ও প্রতারণা ভালোবাসার বন্ধন নষ্ট করে দেয়।