জন্ম ২০ অক্টোবর ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দ, ঢাকা; মৃত্যু ২৬ আগস্ট ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দ, লক্ষ্ণৌয়ে। বাবা রামপ্রসাদ সেনের আদি বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার মগর গ্রামে। তিনি যৌবনে ব্রাক্ষ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ঢাকায় চিকিতসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি হয়েছিল। অতুলপ্রসাদ ছোট বয়সেই বাবাকে হারিয়ে দাদু কালীনারায়ণ গুপ্তের স্নেহে বড় হন। ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুকাল প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ণ করে অতুলপ্রসাদ বিলেতে যান এবং ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। কলকাতায় ও রংপুরে কিছুদিন আইন-ব্যবসা করবার পর তিনি লক্ষ্ণৌ শহরকে নিজের কর্মস্থান হিসেবে বেছে নেন। এইখানেই তিনি ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠ ব্যবসাজীবীদের মধ্যে আসন লাভ করেন; আউধ বার এসোসিয়েশন ও আউধ বার কাউন্সিলের তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দাদু কালীনারায়ণ ভগবদভক্ত, সুকন্ঠ গায়ক ও সহজ ভক্তিসংগীত রচয়িতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন; অতুলপ্রসাদ দাদুর এইসব গুণের অধিকারী হয়েছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি যে গান রচনা করেছিলেন (‘তোমারি যতনে তোমারি উদ্যানে’), এখনও সেটি ব্রক্ষ্মসংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। নানাকর্মব্যস্ত বেদনাহত জীবনে এই সংগীত রচনাই চিরদিন তাঁর মনের এক প্রধান আশ্রয় ছিল। ওঁর লেখা গানের সংখ্যা বহু নয়, দুশর কিছু বেশি; কিন্তু তাদের সুর ও ভাব-বৈশিষ্ট্যে তিনি আধুনিক বাংলা গানকে সম্বৃদ্ধ করে গিয়েছেন।
পরাধীনতার বেদনায় রচিত তাঁর গান ‘উঠো গো ভারতলক্ষ্মী’, ‘বল বল বল সবে শতবীণা বেণুরবে’, ‘হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর’ প্রভৃতির জনপ্রিয়তা স্বাধীন ভারতেও অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর ভগবতসংগীত, প্রকৃতি ও প্রেম-গাথা, সর্বত্রই যে গভীর বেদনার মধ্যেই ভক্তি ও প্রেমের আস্পদের প্রতি একান্ত আত্মনিবেদন ও নির্ভর- কথার ঋজুতায় ও সুরের বৈচিত্রে মূর্ত হয়েছে। তার ফলে তাঁর রচিত গান দীর্ঘকাল ধরে বাঙালী শ্রোতার মর্মস্পর্শী হয়ে আছে।
বাংলা কাব্যগীতির বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ না করে তিনি তাঁতে হিন্দুস্থানী সংগীতের সুরবিশিষ্ট ঢঙের সার্থক যোগসাধন করেছেন; বাউল ও কীর্তনের সুরের যোগসাধন করে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে হিন্দুস্থানী ঢঙের সংযোজন করে তিনি বাংলা গানে বৈচিত্র্যের সঞ্চার করেছেন। তাঁর গানগুলি ‘গীতিগুঞ্জ’ (১৯৩১ খ্রী) গ্রন্থে সংকলিত হয়; তার আগে ‘কয়েকটি গান’ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কাকলি’ গ্রন্থমালায় এইসব গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
অন্তর্মুখী এবং ভগবতমুখী গীতিরচয়িতা অতুলপ্রসাদ বাইরের জীবনে নিজের প্রতিভার চিহ্ন নানা ভাবে রেখে গেছেন। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যে সব বাঙালী বিভিন্ন প্রদেশকে নিজের কর্মভূমি বলে স্বীকার করে জনসেবার মাধ্যমে সেই সব জায়গায় অধিবাসীদের ঐকান্তিক শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, অতুলপ্রসাদ সেনের নাম তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। প্রবাসী বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক হয়েও, চিরিদিন বাংলা ভাষার সেবা ও জন্মভূমির স্মৃতি অন্তরে বহন করেও, অন্য প্রদেশে তিনি নিজেকে কখনো প্রবাসী বলে মনে করেননি- “নিজেদের প্রবাসী বলতে আমি সংকোচ বোধ করি। ভারতে বাস করে ভারতবাসী নিজেকে পরবাসী কি করে বলবে?… এ দেশও আমাদের দেশ”।
আর এই দেশের কল্যাণকর্মে তিনি শ্রম, অর্থ ও প্রীতি অকুণ্ঠ ভাবে নিয়োগ করেছিলেন। যুক্তপ্রদেশ, বিশেষতঃ লক্ষ্ণৌ নগরীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রতি তিনি সম্পূর্ণ একাত্ম হয়েছিলেন; লক্ষ্ণৌ শহরের যে রাজপথের পাশে তাঁর বাড়ি ছিল, তাঁর জীবিতকালেই তাঁর নামে সেই রাজপথ সরকারি ভাবে চিহ্নিত হয়েছিল; দীনদুঃখীকে উদার হাতে দান করে, সার্বজনিক নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মভার নিয়ে তিনি সর্বধারণের হৃদয়ে যে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন- মৃত্যুর পর তাঁর গুণানুরাগীগণ লক্ষ্ণৌ শহরে তাঁর মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিনি বিশেষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেখানে তাঁর স্মরণে একটি ‘হল’ চিহ্নিত হয়েছে।
রাষ্ট্রনৈতিক কর্মের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। গোখেলের অনুবর্তী হিসেবে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরে লিবারাল ফেডারেশন বা উদারনৈতিক সংঘভুক্ত হন ও এর বার্ষিক সম্মিলনে সহ-সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রবাসে (বর্তমানে নিখিল ভারত) বঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলন প্রতিষ্ঠা কালে তিনি তার অন্যতম প্রধান; সম্মেলনের মুখপাত্র উত্তরা-র তিনি অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। সম্মেলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনে তিনি সভানেতৃত্ব করেন। তাঁর উপার্জনের একটা বড় অংশ জীবিতকালেই লোকসেবায় ব্যয় করেছিলেন; অবশিষ্ট সম্পত্তির বেশির ভাগই, তাঁর আসবাব-গৃহ এবং গ্রন্থস্বত্বও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করে গেছেন।