স্বামী বিবেকানন্দ
পাশ্চাত্যে মনোবিজ্ঞানের ধারণা অতি নিম্নস্তরের। ইহা একটি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান; কিন্তু পাশ্চাত্যে ইহাকে অন্যান্য বিজ্ঞানের সমপর্যায়ভুক্ত করা হইয়াছে – অর্থাৎ অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো ইহাকেও উপযোগিতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। কার্যতঃ মানবসমাজের উপকার ইহার সাহায্যে কতটা সাধিত হইবে? আমাদের ক্রমবর্ধমান সুখ ইহার মাধ্যমে কতদূর বর্ধিত হইবে? যে-সকল দুঃখ-বেদনায় আমরা নিয়ত পীড়িত হইতেছি, সেগুলি ইহা দ্বারা কতদূর প্রশমিত হইবে? – পাশ্চাত্যে সব কিছুই এই মাপকাঠিতে বিচার করা হয়।
মানুষ সম্ভবত: ভুলিয়া যায় যে, আমাদের জ্ঞানের শতকরা নব্বই ভাগ স্বভাবতই মানুষের পার্থিব সুখদুঃখের হ্রাসবৃদ্ধির উপর কোন কার্যকর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না। আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অতি সামান্য অংশই দৈনন্দিন জীবনে কার্যতঃ প্রযুক্ত হয়। ইহার কারণ এই যে, আমাদের চেতনমনের অতি সামন্য অংশই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে বিচরণ করে এবং ঐ সামান্য ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানকেই জীবন ও মনের সব কিছু বলিয়া আমরা কল্পনা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের অবচেতন মনের বিশাল সমুদ্রে উহা একটি সামান্য বিন্দুমাত্র। যদি আমাদের অস্তিত্ব শুধু ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিত, তাহা হইলে আমরা যে-সব জ্ঞান অর্জন করি, সেগুলি শুধু ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তির জন্যই ব্যাবহৃত হইত। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় বাস্তব ক্ষেত্রে তাহা হয় না। পশুস্তর হইতে যতই আমরা উপরে উঠিতে থাকি, আমাদের ইন্দ্রিয়-সুখ-বাসনা ততই হ্রাস পাইতে থাকে এবং বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক বোধের সহিত আমাদের ভোগাকাঙ্ক্ষা সূক্ষ্মতর হইতে থাকে এবং ‘জ্ঞানের জন্যই জ্ঞানের অনুশীলন’- এই ভাবটি ইন্দ্রিয়-সুখ – নিরপেক্ষ হইয়া মনের পরম অনন্দের বিষয় হইয়া উঠে।
পাশ্চাত্যের পার্থিব লাভের মাপকাঠি দিয়া বিচার করিলেও দেখা যাইবে যে, মনোবিজ্ঞান সকল বিজ্ঞানের সেরা। কেন? আমরা সকলেই ইন্দ্রিয়ের দাস, নিজেদের চেতন ও অবচেতন মনের দাস। কোন অপরাধী যে স্বেচ্ছায় কোন অপরাধ করে – তাহা নয়, শুধু নিজের মন তাহার আয়ত্তে না থাকাতেই সে ঐরূপ করিয়া থাকে, এবং এইজন্য সে তাহার চেতন ও অবচেতন মনের, এমন কি প্রত্যেক মনেরও দাস হয়। সে নিজ-মনের প্রবলতম সংস্কারবশেই চালিত হয়। সে নিরুপায়। সে নিজমনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবেকের কল্যাণকর নির্দেশ এবং নিজের সৎস্বভাবের বিরুদ্ধে চালিতে থাকে। সে তাহার মনের প্রবল নির্দেশ মানিয়া চলিতে বাধ্য হয়। বেচারী মানুষ নিতান্তই অসহায়।
প্রতিনিয়ত ইহা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে প্রত্যক্ষ করিতেছি। অন্তরের শুভনির্দেশ আমরা প্রতিনিয়ত অগ্রাহ্য করিতেছি এবং পরে ঐজন্য নিজেরাই নিজেদের ধিক্কার দিতেছি। আমরা বিস্মিত হই কিভাবে ঐরূপ জঘন্য চিন্তা করিয়াছিলাম এবং কিভাবেই বা ঐ প্রকার হীনকার্য আমাদের দ্বারা সাধিত হইয়াছিল। অথচ আমরা পুনঃপুনঃ ইহার জন্য দুঃখ ও আত্মগ্লানি ভোগ করি। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আমাদের মনে হয় যে, ঐ কর্ম করিতে আমরা ইচ্ছুক ছিলাম, কিন্তু তাহা নয়, আমরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হইয়া ইহা করিয়াছিলাম। আসলে আমরা নিরূপায়! আমরা সকলেই নিজেদের মনের গোলাম ও অপরের মনেরও। ভালমন্দের তারতম্য এক্ষেত্রে প্রায় অর্থহীন। অসহায়ের ন্যায় আমরা ইতস্ততঃ চালিত হইতেছি। আমরা মুখেই বলি, আমরা নিজেরা করিতেছি ইত্যাদি; কিন্তু আসলে তাহা নয়।
চিন্তা করিতে ও কাজ করিতে বাধ্য হই বলিয়া আমরা চিন্তা ও কাজ করিয়া থাকি। আমরা নিজেদের ও অপরের দাস। আমাদের অবচেতন মনের অতি গভীরে অতীতের চিন্তা ও কর্মের যাবতীয় সংস্কার পুঞ্জীভূত হইয়া আছে—শুধু এ-জীবনের নয়, পূর্ব পূর্ব জীবনেরও। এই অবচেতন মনের অসীম সমুদ্র অতীতের চিন্তা ও কর্মরাশিতে পরিপূর্ণ। এই-সকল চিন্তা ও কর্মের প্রত্যেকটি স্বীকৃতিলাভের চেষ্টা করিতেছে, নিজেকে প্রকাশ করিতে চাহিতেছে, একটি অপরটিকে অতিক্রম করিয়া চেতন-মানসে রূপ পরিগ্রহ করিতে প্রয়াস পাইতেছে—তরঙ্গের পর তরঙ্গের আকারে, উচ্ছ্বাসের পর উচ্ছ্বাসে তাহাদের প্রবাহ। এই-সকল চিন্তাও পুঞ্জীভূত শক্তিকেই আমরা স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা, প্রতিভা প্রভৃতি শব্দে অভিহিত করি, কারণ উহাদের যথার্থ উৎপত্তিস্থল আমরা উপলব্ধি করি না।
অন্ধের মতো বিনা প্রতিবাদে উহাদের নির্দেশ আমরা পালন করি। ফলে দাসত্ব চরম অসহায় দাসত্ব আমাদিগকে চাপিয়া ধরে, অথচ নিজেদের ‘মুক্ত’ বলিয়া আমরা প্রচার করি। হায়, আমরা নিজেদের মনকে নিমেষের জন্য সংযত করিতে পারি না, বস্তু-বিশেষে উহাকে নিবদ্ধ রাখিতে পারি না, বিষয়ান্তর হইতে প্রত্যাহৃত করিয়া মুহূর্তের জন্য একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করিতে পারি না! অথচ আমরাই নিজেদের মুক্ত বলি। ব্যাপারটা চিন্তা করিয়া দেখ। যেভাবে করা উচিৎ বলিয়া আমরা জানি, অতি অল্প সময়ের জন্যও আমরা সেভাবে করিতে পারি না।
মূহূর্তে কোন ইন্দ্রিয়-বাসনা মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে এবং তৎক্ষণাৎ আমরা উহার আজ্ঞাবহ হইয়া পড়ি। এরূপ দুর্বলতার জন্য আমরা বিবেক-দংশন ভোগ করি, কিন্তু পুনঃপুনঃ আমরা এইরূপই করিয়া থাকি এবং সর্বদাই ইহা করিতেছি। যত চেষ্টাই করি না কেন, একটি উচ্চমানের জীবন আমরা যাপন করিতে পারি না। অতীত জীবন এবং অতীত চিন্তাগুলির ভূত যেন আমাদিগকে দাবাইয়া রাখে। ইন্দ্রিয়গুলির এই দাসত্ব জগতের সকল দুঃখের মূল। জড়দেহের ঊর্ধ্বে উঠিবার অসামর্থ্য-পার্থিব সুখের জন্য চেষ্টা আমাদের সকল দুর্দশা ও ভয়াবহতার হেতু।
মনের এই উচ্ছৃঙ্খল নিম্নগতিকে কিভাবে দমন করা যায়, কিরূপে উহাকে ইচ্ছাশক্তির আয়ত্ত করা যায়, এবং উহার দোর্দণ্ড প্রভাব হইতে মুক্তিলাভ করা যায়, মনোবিজ্ঞান তাহারই শিক্ষা দেয়। অতএব মনোবিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান; উহাকে বাদ দিলে অন্যান্য বিজ্ঞান ও জ্ঞান মূল্যহীন।
অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল মন আমাদিগকে নিয়ত নিম্ন হইতে নিম্নতর স্তরে লইয়া যাইবে এবং চরমে আমাদিগকে বিধ্বস্ত করিবে, ধ্বংস করিবে। আর সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত মন আমাদিগকে রক্ষা করিবে, মুক্তিদান করিবে। সুতরাং মনকে অবশ্য সংযত করিতে হইবে। মনোবিজ্ঞান আমাদিগকে মনঃসংযমের পদ্ধতি শিক্ষা দেয়।
যে-কোন জড়বিজ্ঞান অনুশীলন ও বিশ্লেষণ করিবার জন্য প্রচুর তথ্য ও উপাদান পাওয়া যায়। ঐ-সকল তথ্য ও উপাদানের বিশ্লেষণ এবং পরীক্ষার ফলে ঐ বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানলাভ হয়। কিন্তু মনের অনুশীলন ও বিশ্লেষণে সকলের সমভাবে আয়ত্তাধীন কোন তথ্য ও বাহির হইতে সংগৃহীত উপাদান পাওয়া যায় না—মন নিজের দ্বারাই বিশ্লেষিত হয়। সুতরাং
মনোবিজ্ঞানকেই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বলিয়া ধরা যায়। পাশ্চাত্যে মানসিক শক্তিকে, বিশেষতঃ অসাধারণ মানসিক শক্তিকে, অনেকটা যাদুবিদ্যা ও গূঢ় যৌগিক ক্রিয়ার সামিল বলিয়া গণ্য করা হয়। বস্তুতঃ সেই দেশে তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাবলীর সহিত মিশাইয়া ফেলিবার ফলে মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের অনুশীলন ব্যাহত হইয়াছে, যেমন হইয়াছে সেই-সকল সাধু-ফকির সম্প্রদায়ের মধ্যে, যাঁহারা সিদ্ধাই-জাতীয় ব্যাপারে অনুরক্ত।
পৃথিবীর সর্বত্র পদার্থবিদ্গণ একই ফললাভ করিয়া থাকেন। তাঁহারা সাধারণ সত্যসমূহ এবং সেগুলি হইতে প্রাপ্ত ফল সম্বন্ধে একই মত পোষণ করেন। তাহার কারণ পদার্থবিজ্ঞানের উপাত্তগুলি (lata) সর্বজনলভ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য এবং সিদ্ধান্তগুলিও ন্যায়শাস্ত্রের সূত্রের মতোই যুক্তিসিদ্ধ বলিয়া সর্বজনগ্রাহ্য। কিন্তু মনোজগতের ব্যাপার অন্যরূপ। এখানে এমন কোন তথ্য নাই, যাহার উপর নির্ভর করিয়া সিদ্ধান্ত করা যায়, এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন ব্যাপার নাই, এমন কোন সর্বজনগ্রাহ্য উপাদান এখানে নাই, যাহা হইতে মনোবিজ্ঞানীরা একই প্রণালীতে পরীক্ষা করিয়া একটি পদ্ধতি গড়িয়া তুলিতে পারেন।
মনের অতি-গভীর প্রদেশে বিরাজ করেন আত্মা, মানুষের প্রকৃত সত্তা। মনকে অন্তর্মূখী কর, আত্মার সহিত সংযুক্ত কর; এই স্থিতাবস্থার সেই দৃষ্টিকোণ হইতে মনের আবর্তনগুলি লক্ষ্য কর, সেগুলি প্রায় সব মানুষের মধ্যেই দেখা যায়, ঐ-সকল তথ্য বা উপাত্ত ও ঘটনা কেবল তাঁহাদেরই অনুভূতিগম্য, যাঁহারা ধ্যানের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করিতে পারেন। জগতের অধিকাংশ তথাকথিত আধ্যাত্মবাদীদের মধ্যেই মনের গতি, প্রকৃতি, শক্তি প্রভৃতি লইয়া প্রভূত মতভেদ দেখা যায়। ইহার কারণ, তাঁহারা মনোজগতের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করিতে পারেন নাই। তাঁহারা নিজেদের এবং অন্যান্যের মানসিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার সামান্য কিছু লক্ষ্য করিয়াছেন এবং ঐগুলিকেই সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। এবং যে ঐ-সকল একান্ত বাহ্য ও ভাসা-ভাসা অভিব্যক্তির যথার্থ প্রকৃতি না জানিয়া প্রত্যেক ধর্মেই ছিটগ্রস্ত একদল লোক থাকেন, যাঁহারা ঐ সকল উপাদান তথ্য প্রভৃতিকে মৌলিক গবেষণার জন্য নির্ভরযোগ্য বিচারের মান বলিয়া দাবি করেন। কিন্তু সেগুলি তাঁহাদের মস্তিষ্কের উদ্ভট খেয়াল ভিন্ন আর কিছুই নয়।
যদি মনের রহস্য অবগত হওয়াই তোমার অভীপ্সিত হয়, তবে তোমাকে নিয়মানুগ শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। যদি তুমি এমন একটি চেতন স্তরে উঠিতে চাও, যেখান হইতে মনকে পর্যবেক্ষণ করিতে পারিবে এবং মনের উচ্ছৃঙ্খল আবর্তনে কিছুমাত্র বিচলিত হইবে না, তবে মনকে সংযত করিতে অভ্যাস কর। নতুবা তোমার পরিদৃষ্ট ঘটনাগুলি নির্ভরযোগ্য হইবে না, সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না এবং মোটেই যথার্থ উপাদান ও তথ্য বলিয়া স্বীকৃত হইবে না।
যে-সকল মানুষ মনের প্রকৃতি লইয়া গভীরভাবে অনুশীলন করিয়াছে, দেশ বা মত-নির্বিশেষে তাহাদের উপলব্ধি চিরদিন একই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে। বস্তুতঃ মনের গভীরতম প্রদেশে যাহারা প্রবেশ করে, তাহাদের উপলব্ধি কখনও ভিন্ন হয় না।
অনুভূতি ও আবেগপ্রবণতা হইতেই মানুষের মন ক্রিয়াশীল হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আলোর রশ্মি আমার চক্ষুতে প্রবেশ করে, এবং স্নায়ুদ্বারা মস্তিষ্কে নীত হয়, তথাপি আমি আলো দেখিতে পাই না। তারপর মস্তিষ্ক ঐ আবেগকে মনে বহন করিয়া লইয়া যায়, কিন্তু তথাপি আমি আলো দেখি না; মনে তাহার প্রতিক্রিয়া জন্মে, তখনই মনে আলোর অনুভূতি হয়। মনের প্রতক্রিয়াই অনুপ্রেরণা এবং তাহারই ফলে চক্ষু প্রত্যক্ষ দর্শন করে।
মনকে বশীভূত করিতে হইলে তাহার অবচেতন স্তরের গভীরে প্রবেশ করিতে হইবে, সেখানে যে-সকল চিন্তা ও সংস্কার পুঞ্জীভূত হইয়া রহিয়াছে, সেগুলিকে সুবিন্যস্ত করিতে হইবে, সাজাইতে হইবে এবং সংযত করিতে হইবে। ইহাই প্রথম সোপান। অবচেতন-মনকে সংযত করিতে পারিলেই চেতন-মনও বশীভূত হইবে।