তু কেনে কাদা দিলি; সাদা কাপড়ে।
কথাগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন শুনেছি। হয়তো শুনেই চলেছি…। তাই রিসোর্টের ছোট্ট মাটির ঘরটায় শুয়ে শুয়ে দূর থেকে মাদল এর সুর শুনে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখলাম শুধু মাদল ই নয়। ঝুমুর ও আছে সাথে। শান্তিনিকেতন এ আসার উদ্দেশ্যই তো এই সোনাঝুরি র শনিবারের হাট। ‘বেলাশেষে’ ফ্রেমে নিজেদের কে বসিয়ে মিলিয়ে নেওয়া।
গ্রামের হাট ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা আমার থাকলেও আমার সহধর্মীনির ছিল না। তাই তার অবস্থা কিছুটা পাগলপারা। কখন যে তিনি আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন টের ই পাইনি। তাই তাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা না করে মিশে গেলাম সেই পড়ন্ত বিকেলের সোনার আলোয় মাখা সোনাঝুরির শাখা-প্রশাখায়। গানের কথা গুলো বদলে যাচ্ছে। মাদলীয়ার ছন্দ কিন্তু একই ভাবে বয়ে চলেছে। সাঁওতালি রমনীদের এই লাবন্য আমি আগে দেখিনি। শহুরে জিন্স-ক্যাপ্রি-স্কার্ট পরা আধুনিকা রা তাদের কোমর ধরে তাল মেলালেও –
দোল লাগে শাল পিয়াল বনে
নতুন খোঁপার ফুলে লো
(প্রসঙ্গত বলি, আমার স্ত্রী কেও অনেক অনুনয় বিনয় করে বলেছিলাম। ‘আগন্তুক’র মমতাশঙ্কর এর দৃষ্টান্ত ও সামনে রাখলাম। কিন্তু লাজে রাঙা হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ছিল)
শুধু সাঁওতালি নাচ নয়, আমার কাছে সোনাঝুরি’র হাট এ পরম পাওয়া হলো বাউল গান। তাদের পাশে বসে লোকসংগীত শোনার অনুভূতি বলে (পড়ুন লিখে) বোঝানো অন্তত আমার দ্বারা সম্ভব নয়। গানগুলো সবই প্রায় পরিচিত। কিন্তু বেলাশেষের এই গোধূলির আলোয় চার দিকে থেকে ভেসে আসা মাদল এর তাল, সাঁওতালি রমণী দের পায়ের নুপুরের সঙ্গত, বাউলের একতারার তান আমার শান্তিনিকেতন এ প্রথম প্রহর একেবারে মাতিয়ে দিলো। সোনাঝুরি গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে একাদশীর চাঁদ জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষন আগে। কিন্তু সেই আবছা অন্ধকারের ওপার থেকে এখন ভেসে আসছে ঝুমুর গানের কথা গুলো –
‘মুখ মুছে তু ঘর যাবি, ওরে সিয়ানা
আমি কুথা কাদা ধুবো দেকিন দে না।
তু কেনে কাদা দিলি
সাদা কাপড়ে’
এই MeToo র অস্থির সময় গানের কথা গুলো খুব ই গায়ে বিঁধছিলো।
পড়তে পড়তে যখন এতটা পথ চলেই এসেছেন, গান টাও শুনে নিন –
তু কেনে কাদা দিলি
ওই রাঙা মাটির পথে লো
– খোয়াই-কোপাই-পোলাশবনি-
লেখা টা একটু বড় হয়ে গেলো। ইচ্ছা হলে পড়ে দেখবেন। নাহলে ছবিগুলো অন্তত দেখে নেবেন। যদিও অত ইম্পরট্যান্ট নয়। তবে যদি পড়েন তো খুব ভালো লাগবে
পরান যায় জ্বলিয়া রে
দুই পৃথিবী
সংঘর্ষ
পোস্ত
বেলাশেষে
ইষ্টিকুটুম
— এই সব সিনেমা গুলো দেখেননি? তাহলে শান্তিনিকেতন এ যাওয়ার আগেই ঝটপট দেখে ফেলুন। নাহলে সোহম এর কাছে প্রতিপদে ঠোক্কর খেতে হবে। কি কুক্ষনে যে ওর টোটো ভাড়া করেছিলাম। সাইটসিইং করার সময় সুরুল এর জমিদারবাড়ি তে দেব কোথায় ঢাকের তালে নেচেছিল; কোথায় কোন ধাবায় জিৎ আর দেব বাইক নিয়ে উল্টে, পরে লাঞ্চ সেরেছিলো; প্রসেনজিৎ কোথায় তাপস পাল কে ঠেঙ্গিয়েছিলো…শুনতে শুনতে শান্তিনিকেতন এ এসে রবীন্দ্রনাথ কেই ভুলতে বসেছিলাম। তবে ছেলেটা খুব ভালো। টোটো ভাড়ায় ভালো ডিসকাউন্ট দিয়েছিলো (৮৫০ টাকা ভাড়া হলেও, শেষমেষ কত নিয়েছিল বলা বারণ ) আর বেশ যত্নসহকারে ঘুরে দেখিয়েছিলো।
হিন্দি তে বলতে পারলে বলতাম – শান্তিনিকেতন মে আয়ে অউর কোপাই কে পার মে Sunrise নেহি দেখে তো শান্তিনিকেতন মে আয়ে হি কিঁউ! সূর্য ওঠার আগে আমরা উঠে গিয়েছিলাম। মেয়ে টাকে পাশে Nafis দের রুম এ চালান করে দিয়ে টোটো নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম কোপাই এর ধার। ১০০ টাকায় যাওয়া-আসা। যেতে যেতে ভাবছিলাম ভগবান কেন টোটো র স্পিড 30kmph এর বেশি বানায় নি। যাইহোক শেষে সূর্য কে বেশি উঠতে না দিয়ে পৌঁছে গেলাম কোপাই এর তীরে। এক কথায় অপূর্ব। চারদিক সোনালী আলোয় মোড়া। নরম ঠান্ডা একটা আমেজ। একটা খড়ের চালার চা খেতে খেতে সূর্যোদয় দেখা। কাব্য আমার আসে না তাই এর থেকে বেশী সুন্দর করে বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওটা নফিস খুব ভালোভাবে পারে। আমি যেটা পারি – সেই ছবি তে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে হ্যাঁ, খড়ের চলে শিশির বিন্দুর ছবি টা কিন্তু আমার স্ত্রীর তোলা। My better half is getting better in photography
শান্তিনিকেতন বললে যে তিনটে শব্দ আমার মনে আসে, তা হলো – সোনাঝুরি, খোয়াই, কোপাই আর বিশ্বভারতী। এই রে, গুনতি তে একটা বেশি হয়ে গেলো। সোনাঝুরি র হাট এর বর্ণনা ওর ছবি আগের দিন ই দিয়েছি। আজ দিলাম সোনাঝুরি আর খোয়াই এর বনভূমি যেখানে চারপাশের ইউক্যালিপ্টাস এর পাতার ফাঁক গলে আসা সোনালী আলো সারা মনে মেখে নিচ্ছি. ঠিক যেমন বিশ্বনাথ ও আরতি মজুমদার করেছিল। ভাবছেন বিশ্বনাথ ও আরতি আবার কে?? এই জন্য প্রথমেই বলেছি বেলাশেষে সিনেমা টা দেখে নিয়ে তবেই এখানে আসা দরকার ছিল।
বিশ্বভারতী কে খুব অল্পই ছুঁয়েছি। রবি ঠাকুর কে একেবারে সবটা ছোঁয়ার চেষ্টা করা ধৃষ্টতা। তবে অল্পেতে দামোদর শেঠ খুশি না হলেও আমরা বেশ তৃপ্ত। আসছে বছর আবার হবে।
শেষে যার কথা না বললেই নয়। সোহম, আমাদের টোটো ভাই, একটা জায়গা দেখাতে গিয়ে বললো – ‘ওই দেখছেন জায়গাটা ঘেরা আছে, ওখানে অর্চিষ্মান কে বেঁধে রেখে বিয়ে দিয়েদিয়েছিলো’। কেলো করেছে – এই অর্চিষ্মান আবার কে? আমার মেয়ের বন্ধু একজন অর্চিষ্মান আছে বটে। কিন্তু তার বয়স তো সবে ৯ বছর। তাহলে…? সম্বিৎ ফিরলো তার কোথায় – ‘আরেবাবা ইষ্টিকুটুম দেখেন নি?’ ইচ্ছা হচ্ছিলো টোটো থেকে নেমে পড়ি। কিন্তু এই শালগাছে ঘেরা এই পলাশবনি জঙ্গলে আবার টোটো কিভাবে পাবো দুশ্চিন্তা করে থেকে গেলাম। তবে আমার মায়ের আদেশ ছিল পলাশবনির জঙ্গল আর বাহা গ্রামের ছবি দেখাতে হবে। ছবির মতো সুন্দর একটা গ্রাম. পরেরবার খুব সকালে আসার চেষ্টা করবো। বেলা বাড়লে ভিড় ও বাড়ে। মাটির নিকোনো দেওয়ালের পাশে জিন্স-টপ পরা কাউকে দেখলে মনে একটা গানের লাইন মনে আসে –
হি থাক তুকে মানাইছি লাই রে
ইককে বারে মানাইছি লাই রে
——–
Sohom Toto – 7031898932
Babu Toto – 9614664296
——–