কলকাতার আড্ডা বর্তমানে অনেকটাই শহরের ক্যাফে এবং সোশাল মিডিয়া নির্ভর। যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে দাপিয়ে চলছে ক্যাফে-সংস্কৃতি। শুধু কলকাতা নয়, তার ছোঁয়া স্পষ্ট দেখাযায় শহরতলী বা দূরের জেলাগুলিতেও। শহরের অলিতে-গলিতে নিত্যনতুন ক্যাফে খুলছে প্রায়শই। সুস্বাদু পানীয়, জিভে জল আনা খাবারের সঙ্গে সেখানে ছড়িয়ে থাকে অভিনব থিম, অসাধারণ শিল্পভাবনা, আরামদায়ক পরিবেশ। আর থাকে আড্ডা, গল্প-গুজব । আসলে বাঙালিয়ানা আড্ডা ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। চায়ের দোকান, রোয়াকের আড্ডাগুলো সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে উঠেছে, তা বদলে গিয়েছে ক্যাফেতে। আমাদের কলকাতার ক্যাফে সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তনগুলি এসেছে তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে। এটি সময়ের সাথে কেন বা কিভাবে ঘটছে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
পাড়ার চায়ের দোকান – আড্ডার শুরু
ঔপনিবেশিক বাংলায়, আমাদের প্রাত্যহিক সামাজিক যোগাযোগের স্থান হিসাবে আশেপাশের চায়ের দোকান সমূহের বেশ বড় অবদান ছিল একথা অনস্বীকার্য। যদিও এই চায়ের দোকানগুলিতে প্রধানত পুরুষদের আনাগোনাই ছিল কিন্তু ‘আড্ডা’ নামক এই কাজটি দোকানগুলিতে দীর্ঘক্ষণ চলত। এটিকে এক ধরনের মানসিক ব্যায়াম বলা যেতে পারে, যেখানে মানুষ শুধু নিজেদের পরিবারের কথাই বলত না, দৈনন্দিনের বাইরেরও বহু আলোচনা হত। এই আড্ডার উৎপত্তি অস্পষ্ট হলেও এটি ঔপনিবেশিক বাংলায় যথেষ্ট ব্যাপ্ত ছিল এটুকু বলাই যায়। কলকাতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের প্রধান কেন্দ্র এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। তাই শহর কলকাতা এই ধনী বণিক, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, মায় পশ্চিমা শিক্ষায় প্রবেশ করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের যথেষ্ঠ আকর্ষণ করত।
কলকাতায় কফির প্রচলন
অষ্টাদশ শতকের কলকাতায় ইংরেজ সাহেব-সুবো আসলে তখনও যাদের হোম সিকনেস কাটেনি। কথায় কথায় তাঁরা কলকাতাকে লন্ডন বানাতে চায়। পারলে ঘর-বাড়ি পথ-ঘাট সবের সঙ্গেই লন্ডনের চরিত্রকে মিশিয়ে মাখিয়ে দেয়। উইলিয়াম পার্কেস তৈরি করলেন ‘লন্ডন হোটেল’ নামধারী হোটেল এবং একটা ‘কফি রুম’ বানালেন বেশ যত্ন করে। আর সেই ‘কফি রুমে’ এক পেয়ালা কফি পানের খরচ মাত্র সিক্কা টাকা। এই টাকায় কফি পান আর কাগজ পড়া দুই-ই হয়ে যায়।
এসব যখন চলছে ঠিক তখনই কলকাতায় সত্যিকারের একটা ‘কফি হাউস’ তৈরি হল। অনেক ঘটা করে সেটার নাম দেওয়া হল ‘ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কাফি হাউস’। সেখানে কফি পানের সাথে সাথে কলকাতার ইংরেজি কাগজগুলি যেমন পড়া যায় তেমনই আবার মাদ্রাজের যাবতীয় ইংরেজি খবরের কাগজেও চোখ বুলানো যায়। এই কফি হাউসে নিয়মিত ভদ্রলোক, ব্যবসায়ী বণিকের আড্ডা বসতে লাগল সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই। তখন অবশ্য আজকের মতো কলেজ পড়ুয়াদের আড্ডাস্থল হয়ে ওঠেনি সেই কফি হাউস কারণ কলকাতা তখনও ছাত্রসমাজ চোখেই দেখেনি। আজকের যে ‘রয়্যাল এক্সচেঞ্জ’-এর বাড়িটি কলকাতায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেটিই ছিল ওই ‘ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কাফি হাউস’।
১৭৯০ সালের কথা। জন ম্যাকডোনাল্ড কলকাতায় পা দিয়েই অনুভব করলেন ভাল কফি হাউসের অভাব। তিনি স্থির করলেন লন্ডনের ‘জেরুসালেম কফি হাউস’ নামেই একখানা কফি হাউস খুলবেন কলকাতায়। ম্যাকডোনাল্ড বাড়ি কিনলেন একখানা ডালহৌসি স্কোয়ারে। কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট যেখানটায় মিলেছে ডালহৌসি স্কোয়ারে সেখানটায়। জেরুজালেম কফি হাউস খোলা হল। ওখানেও কফি হাউস ভাল জমল না । ওয়েলেসলি সাহেব ভাড়া নিলেন বাড়িটিকে। আর সেখানেই গড়ে উঠল ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’। এভাবেই দিন শেষ হয়ে গেল কলকাতার ‘জেরুজালেম’-এর। তবু কিন্তু আজও দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। বলতে গেলে জীর্ণতা নয় বরং বিরাট বৈভবের কর্পোরেট চেহারা নিয়ে, বর্তমানে “হংকং ব্যাংক” বা HSBC-ডালহৌসি ব্রাঞ্চ হিসাবে।
কফি বোর্ডের ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’
কফি তখন আমাদের দেশিয়দের মধ্যে পানীয় হিসাবে জনপ্রিয় ছিল না। ব্রিটিশদের অধীনে দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত হলেও কফির বেশিরভাগই রপ্তানি হতো। ১৯২৯-৩০ সালের বিশ্বব্যাপী মন্দার জন্য রপ্তানি বাজারের পতনের পর, সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেশ ব্যাপী ইন্ডিয়ান কফি হাউসের চেইন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার প্রথমটি ১৯৩৬ সালে বোম্বেতে খোলা হয়েছিল। কয়েক বছর পর একই ভাবে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হল, যেটি মূলত একটি অডিটরিয়াম ছিল তা ভারতীয় কফি হাউসে রূপান্তরিত হয়েছিল।
গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য, কফি হাউসগুলিতে চায়ের চেয়ে কম দামে কফি বিক্রি করা হয়েছিল এবং কীভাবে এক কাপ কফি তৈরি করতে হয় তার প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছিল। যদিও কলকাতার আশেপাশের রেস্তোরাঁগুলিতে (যেমন পুটিরাম বা দিলখুশা কেবিন) চায়ের জন্য দীর্ঘ সময় কাটানো সম্ভব ছিল না, কিন্তু কফি হাউসে আড্ডার জন্য একটি উষ্ণ পরিবেশ তৈরি করেছিল। কফি হাউস ছিল এমন একটি জায়গা যেখানে কেউ মাত্র এক কাপ কফির সাথে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারে। খাবার অর্ডার করার দরকার ছিল না। এভাবে কফি হাউস হয়ে ওঠে আড্ডার আদর্শ স্থান বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও বেকারদের জন্য। প্রথমবারের মতো কফি হাউসটি শহরে একটি স্থান প্রদান করেছিল, যা ধর্ম, জাতি, বর্ণ, শ্রেণী এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যমুক্ত ছিল।
চৌরঙ্গির কফি হাউজ
চল্লিশের দশকে বাংলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের এক জমজমাট আড্ডার আসর ছিল চৌরঙ্গির কফি হাউজ। ১৯৪৫-৪৬ সালে এই আড্ডায় নিত্য যাতায়াত ছিল সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায় ও রাধাপ্রসাদ গুপ্তের মতো ব্যক্তিদের। সত্যজিতের অনবদ্য চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালি’র ভাবনাও এই আড্ডা থেকেই শুরু।
আরও পড়ুন: কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি অজ্ঞাত রচনা “মাতৃভাষা এবং সাহিত্য
বর্তমানে কলকাতার আড্ডা – ক্যাফে সংস্কৃতি
সমসাময়িক কালে, ক্যাফেগুলি পুরো কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু সিসিডি এবং বারিস্তার মতো দেশ-ব্যাপী ক্যাফেই নয়, শহরের অন্য গলিতেও ছোট ছোট ক্যাফে রয়েছে। ইন্ডিয়ান কফি হাউস এর রং করা দেয়াল ও অপরিষ্কার সিঁড়ি এখনও গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতার লোকেদের আড্ডার জন্য নতুন জায়গা বেড়েছে। এই শহুরে ক্যাফেগুলি ভোক্তাদের জীবনধারাও পূরণ করে। ক্যাফেগুলি নানান সুবিধার সাথেও আসে যেমন বই ক্যাফে বা পোষা প্রাণীর ক্যাফে যেখানে আপনি নিজের পোষা প্রাণী আনতে পারেন, ক্লান্তিকর দিনের পরে অন্য পোষা প্রাণীর সাথে কিছু সময় কাটাতে যেতে পারেন৷ শহরের কিছু ক্যাফে লাইভ মিউজিক পারফরম্যান্সের আয়োজনও করে। শহুরে ক্যাফেগুলিতে গ্রাহকদের জন্য উন্মুক্ত ওয়াইফাই অ্যাক্সেস স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যার কারণে অনেকেই ক্যাফে থেকে কাজ করা বেছে নেয়।
মিন্টো পার্কের আর্টি ক্যাফে বা লেক গার্ডেনের কাছে লাইটহাউস ক্যাফে তাদের সুন্দর, ভালো আলোকিত পরিবেশ, ভালো খাবার এবং বিভিন্ন ধরনের চা/কফির কারণে কাজ করার সেরা জায়গা হতে পারে। কফি হাউস যেমন তার বহিরাগত খাবারের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তেমনি নতুন যুগের ক্যাফেগুলিও সারা বিশ্ব থেকে রন্ধনপ্রণালীগুলির মধ্য থেকে দারুন সব মেনু অফার করে৷ এইভাবে কফি শপ গুলি তাদের গ্রাহকদের বৈচিত্রপুর্ন খাবারের স্বাদ দেয়।
এই ক্যাফেগুলি ইভেন্টগুলির পরিবর্তনের সাথে নিজেদের আপডেট করে এবং দুর্গা পূজা বা ঈদ বা নববর্ষের মতো অনুষ্ঠানে নতুন মেনু এবং কখনও কখনও ছাড় দেয়। যাইহোক, এই ক্যাফেগুলি ভারতীয় কফি হাউসের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। কিন্তু পরিবারের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে, এই শহুরে ক্যাফেগুলি সমসাময়িক জনসাধারণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই স্থানগুলি অ-বৈষম্যহীন এবং আড্ডার বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা আজ সাংস্কৃতিক সংলাপ এবং আদান-প্রদানের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
তথ্য সুত্র:
1. https://archive.roar.media/bangla/main/history/nostalgic-of-adda-in-bengali-community
2. কলকাতার আড্ডা – সমরেন্দ্র দাস (Editor) – Published by গাঙচিল
3. https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/changing-faces-of-kolkata-adda-dgtl-1.267223