আকাশকুসুমের-অধিকার

মিহির চক্রবর্তী

গণিতশিল্পী ছাড়া ‘আকাশকুসুম’-এর চাষ-আবাদ করার ক্ষমতা ও দুঃসাহস বিজ্ঞান জগতের আর কোন সাধকের থাকতে পারে? বিজ্ঞান জগতের বাইরে (সত্যিই বাইরে কি?) হয়তো আছে কবির, হয়তো শিল্পীর।

তবে রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করি কথকতা। এমন রসিক পাগল আর কে আছেন? তাঁরই একটি ছোট্ট রচনা ‘পাগল’ —

‘পাগল শব্দটা আমাদের কাছে, ঘৃণার শব্দ নহে। খ্যাপা নিমাইকে আমরা খ্যাপা বলিয়া ভক্তি করি; আমাদের খ্যাপা দেবতা মহেশ্বর।’

আমরা শব্দটিকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে নিষ্কৃতি খুঁজি না। আমাদের বাউলরা তো নিজেদের ‘খ্যাপা’ই বলেন। এরই সাথে যে শব্দটি তা ‘সুখ’ নয় ‘আনন্দ’।

‘সুখ প্রতিদিনের সামগ্রী, আনন্দ প্রত্যহের অতীত। সুখ শরীরে কোথাও পাছে ধুলা লাগে বলিয়া সংকুচিত, আনন্দ ধুলায় গড়াগড়ি দিয়া নিখিলের আপনার ব্যবহার ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দেয়। … সুখ বাহিরের নিয়মে বদ্ধ, আনন্দ সে বন্ধন ছিন্ন করিয়া আপনার নিয়ম আপনিই সৃষ্টি করে।’

খ্যাপা সুখ-প্রত্যাশী নয়, অন্যের তৈরী নিয়মে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে রাজী হয় না সে।

‘যাহা রহিয়াছে, যাহা আছে, তাহাকেই চিরস্থায়ীরূপে রক্ষা করিবার জন্য সংসারে একটা বিষম চেষ্টা রহিয়াছে; ইনি সেটাকে ছারকার করিয়া দিয়া, যাহা নাই তাহার জন্য পথ করিয়া দিতেছেন। ইঁহার হাতে বাঁশী নাই, সামঞ্জস্য সুর ইঁহার নহে; পিনাক বাজিয়া ওঠে, বিধিবিহিত যঞ্জ নষ্ট হইয়া যায়, এবং কোথা হইতে একটি অপুর্বতা উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসে।’

অন্যদের ‘বিষয়’ নিতান্তই ‘বাস্তব’। পদার্থবিদ্যার- জড়পদার্থ, তার মধ্যেকার অণুপরমাণু, তাদের গতিময়তা ও টানাপোড়েন, বটানিস্টের- উদ্ভিদ, তার বৈচিত্র, তার জন্ম-মৃত্যু, জীববিজ্ঞানীজীবজগৎ, তাদের ভালবাসা, তাদের বাঁচার নিয়মাবলী। বিষয় জ্ঞাতার বাইরে, তার অস্তিত্ব জ্ঞাতা-নিরপেক্ষ এবং প্রচেষ্ঠা থাকে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাতা-নিরপেক্ষ জ্ঞান অনুসন্ধানের। এ জ্ঞানের রূপ বাক্যবিন্যাসে, যে বাক্য উচ্চারিত হওয়ার আগেই সত্য অথবা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। কোনো এক সময় ভাষা ছিল না, কিন্তু বিস্ময় ছিল। তারপর এক মহালগ্নে আমরা প্রথম উচ্চারণ করতে জানলাম ‘সুর্য’, ‘পৃথিবী’, ‘আবর্তন’। প্রথম প্রকৃতিপাঠক বললেন ‘সুর্য পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হয়’। মিথ্যে হয়েই জন্ম নিল বাক্যটি। (আজকাল অনেকেই এসবে, এই জ্ঞাতা-নিরপেক্ষতায়, সন্দিহান, জানি, তবু তা এখনো সন্দেহেই। ভাবনার মূল কাঠামোয় তেমন কোনো বদল ঘটেছে বলে মনে হয় না।)

বিপরীতে গণিতসাধকের জ্ঞেয় বিষয় তাঁর মনের মধ্যেই, তাঁর কল্পনায়। একটি কাগজে, রুলার দিয়ে একটি রেখা আঁকা হল। গণিতবিদ তার বাইরে অবস্থিত এই বস্তু রূপটিকে অন্য সকলের মতই দেখেন। কিন্তু এটিই তাঁর বিষয় নয়। তাঁর কল্পনায় তিনি এবার রেখাটির বাস্তব প্রস্থকে মুছে ফেলতে ফেলতে তাকে একেবারে সীমায় ঠেলে নিয়ে যান। আবার অন্যদিকে রেখাটি দুদিকেই প্রসারিত করতে থাকেন যে কোনো সীমা অতিক্রম করে। কল্পনার এই খেলায় কাগজের উপরকার বাস্তব, সীমায়িত, প্রস্থবান রেখাটি অন্য রূপ যায়- এ রূপ আর বাইরে নেই, সমস্তটাই গণিতশিল্পীর মনে। এই যে বিষয়কে মনে মনে গড়ে নেওয়া, বাস্তবতা থেকে অবাস্তবতায় প্রসারিত করা, এই কাজে গণিতবিদকে একজন শিল্পী বা কারিগর বলে মনে হতেই পারে। বাইরের বস্তুটি নয়, সেই বস্তুটি বা বস্তুর আভাসটিকে কেন্দ্রে নিয়ে গড়ে তোলা মানসপ্রতিমা; এবং এই গড়ে তোলা গণিতস্রষ্টারই মনের কারুকাজ দিয়ে। নতুন এই রহস্যময়, রূপটিকে এবারে তিনি বরণ করে নেন তার ‘বিষয়’ হিসাবে এবং যথেষ্ট বিস্ময়ে তাকে, সেই বিষয়কে, পর্যবেক্ষণ করেন। বিষয়টিকে তার রহস্যাবৃত মনে হয় এবং এই রহস্যের উন্মোচন তাঁর কাছে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

এভাবেই গড়ে ওঠে একটি নতুন রূপ, যা বস্তুত গণিতস্রষ্টার মনেরই সৃষ্টি, যার কাছে স্রষ্টা নিজেই আবার নতজানু, যেভাবে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী নতজানু প্রকৃতির কাছে।

প্রকৃতিবিজ্ঞানীর সঙ্গে প্রকৃতির একটি খেলা চলে। বিজ্ঞানী এই খেলায় একজন বুদ্ধিমান কল্পনাক্ষম প্রার্থী – প্রার্থী তাঁর বিষয় প্রকৃতির কাছে। গনিতবিদও এই ধরনের এক খেলাতেই লিপ্ত হন। তবে তার খেলার সামগ্রী তিনি গড়ে নেন নিজেই।

( এ সামগ্রী কতটা স্রষ্টা নির্ভর? বাস্তব রেখাটি থেকে উদ্ভুদ এই যে নতুন রূপ, এর মধ্যে কি একটি উনিভার্সালিটি থাকে? সকল সুস্থ কল্পনাশীল মানুষই মনের এই কারিগরিতে পারদর্শী, সকলেই সেই আইডিয়াল রেখা-রূপটি মনের আর্শীতে দেখতে সক্ষম।

প্লেটো বলবেন অন্যভাবে। তিনি বলবেন, এই রূপটিই বাস্তব। The so called real world of experience is not at all real. We are like dwellers in a cave, who perceive the shadows of the external world and mistake the shadow for the real thing. )

তখনই অপরিহার্য হয়ে পড়ে কথা। অন্য বিজ্ঞানী তাঁর বিষয় দেখিয়ে দিতে পারেন, যেমন – এই একটি বৃক্ষ, অথবা এই একটুকরো উল্কাপিন্ড, অথবা এমনকি, এই একটি ইলেক্ট্রন। বিষয় উপস্থাপনার জন্য কথা তাঁর ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। কথাত ভুমিকা দ্বিতীয় পর্যায়ে, বিষয়-এর জ্ঞানের বাহক হিসাবে।

কিন্তু গণিতের বিষয় মানেই একটি বা কয়েকটি গুনের বর্ণনা – বিন্দু; যার অবস্থান আছে অথচ পরিমাপ নেই; সংখ্যা – কোনো বস্তুসমষ্টির সেই ধর্ম যা পড়ে থাকেই বস্তুগুলি থেকে তাদের সমস্ত বিশেষ গুনাবলী, যেমন রঙ, আকার, গন্ধ বা এমনি সবকিছু, সরিয়ে নিলেও।

কথার মতো শক্তিমান অ-বাস্তব আর কী আছে? কয়েকটি ধ্বনি দিয়ে অথবা চিহ্ন দিয়ে পর পর সাজিয়ে তোলা একট পরম্পরা, একান্তই এবস্ট্রাক্ট গঠন একটি, কঈ মায়ার খেলায় জড়িয়ে ফেলেছে মানুষকে, ধ্বনির গঠন আবার তৎক্ষনাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়ের অস্তিত্বের পরেই তার বর্ণনা আসে। এখানে বর্ণনা দিয়েই বিষয়ের সৃষ্টি।

(তুলনা – বিষয় ; মৎসকন্যা = মাছের শরীর, মানুষীর মুখ, জলে ভেসে বেড়ায়।) বাইরে নেই। মনে আছে। ভালবাসায় আছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ মনে পড়ে? ‘পুপে দিদিমনিকে ধারা বেয়ে যে গল্প বলে যাচ্ছি সেই গল্পের মূল অবলম্বন একটি সর্বনামধারী, সে কেবলমাত্র বাক্য দিয়ে তৈরী।’

এই এবস্ট্রাকশন এবং বাণী-নির্ভরতার ফলে axiomatization হয়ে পড়ে গণিতের গঠনপ্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ।

কয়েকটি বাক্য উপস্থিত করা হয় খেলার টেবিলে। ধরে নেওয়া হয় কিছু সামগ্রী আছে যারা ঐ বাক্যে উল্লেখিত গুনাবলির আধার। বেশ ভালো হয় ইতিপুর্বে গঠিত কিছু গণিত-সামগ্রীর যদি ঐ গুনাবলী থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, গণিতের ইতিহাসের প্রথম সৃষ্ট axiom-গুলির জন্য ঈপ্সিত আদিম সামগ্রীগুলির প্রামান্য নয়। খানিকটা বোধ বা কান্ডজ্ঞাণের ওপর ছেড়ে দিতে হয় এদের অস্তিত্বকে।

যেমন ইউক্লিডিয় জ্যামিতির axiom-গুলি অথবা পিয়ানোর সংখ্যাসুংক্রান্ত axiom-গুলি। প্রথম গুচ্ছকে ধারন করার জন্য আছে বিন্দু, সরলরেখা ইত্যাদি জ্যামিতির অবাস্তব বস্তুগুলি। আর দ্বিতীয় গুচ্ছের জন্য বিমুর্ত পূর্ণ সংখ্যার দল।

এইভাবেই বাস্তব বস্তু থেকে কল্পনায় এবং তার পরে সে কল্পনার বাণীরূপ। অথবা বাস্তব বস্তুর আভাস থেকে কথা এবং কথা থেকে কল্পনায় এক রূপের অবয়ব গড়ে তোলা।

ঠিক এখানেই সেই পুরনো প্রশ্নটি এসে যায়। কথা ছাড়া মানুষ কী ভাবনা করতে পারে? বাণীহীন অর্থাৎ ভাষা গড়ে ওঠেনি যাদের তারা কি কল্পনা করতে পারে? ভাবতে পারে? অন্তত স্ট্রাকচারড বিমুর্ত ভাবনা? গণিতের মতো ভাবনা?

প্রাথমিক গঠনের পরে যে এবস্ট্র্যাকট রূপটি তৈরি হল তার কিছু নির্দিষ্ট গুনাবলী আসে। এই অবাস্তব বস্তুগুলির ‘সত্য কাহিনী’ সেগুলি।

সে গুনাবলীর ‘আবিস্কার’ও গণিতকর্মির কাজ, দ্বিতীয় পর্যায়ের। এই অনুসন্ধানের জন্য ল্যাবরেটরি সাজাতে হয় তাঁকে – যে ল্যাবরেটরির মূল মন্ত্র হল লজিক এবং পদ্ধতি হল গাণিতিক প্রমানের মধ্য দিয়ে যাওয়া। প্রমানপদ্ধতি মাত্রেই এবস্ট্রাক্ট। সুর্যের আকৃতি গোলাকার – এর প্রমাণ সরাসরি, প্রকৃত তথ্য খোঁজার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ত্রিভুজের কোনের সমদ্বিখন্ডক তিনটি একই বিন্দু দিয়ে যায় – একথার প্রমান যুক্তি-তর্ক দিয়ে করতে হয়। এই বিমুর্ত কথা চলাচলের মধ্য দিয়ে যে সিদ্ধান্ত আসে তা এত অমোঘ, এত সন্দেহাতীত মনে হয় কেন – এটা এক বিষ্ময়।

ফলত গণিত জগতের বিচরণকারীর কাজ দ্বিবিধ;
শিল্পী হিসাবে – আশ্চর্য, অসম্ভব, সুন্দর রূপের নির্মাণ।
আবিস্কারক হিসাবে – সেই নির্মিত রূপের অজ্ঞাত গুণাবলীর অনুসন্ধান।

অজ্ঞাত গুণাবলীর আবিস্কারের পদ্ধতিটি আরো একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। Axiom-গুলি দিয়ে রূপ নির্মানের পর নির্মাতার দায়িত্ব মূলত শেষ, যদিও রূপের মুল এককগুলি সাজিয়ে অন্যান্য বিচিত্র মিশ্র রূপ সৃষ্টির কাজেও শিল্পীসত্তাই ক্রিয়াশীল। সীমাবদ্ধ রেখা আর বিন্দু-রূপ দিয়ে যেমন বৃত্ত-রূপ, topological space এবং group মিলিয়ে যেমন topoligical group ।

এরপর আবিস্কারক হিসাবে গণিতকর্মির কাজের শুরু। তিনি তখন একের পর এক সৃষ্ট রূপগুলির গুণনির্দেশক বাক্য (কথার মাহাত্য আবার লক্ষনীয়) উপস্থাপিত করেন এবং প্রশ্ন করেন, এ কি সত্যি না মিথ্যে? সত্যি, মিথ্যে শব্দ দুটি বহির্বিশ্বের জ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য হয়। গণিতের ক্ষেত্রে বরং বলা ভালো বাক্যটি প্রামান্য না অ-প্রামান্য। এতদিনের বিশ্বাস ছিল একটি অথবা অন্যটি হতে বাধ্য। সম্প্রতি তিরিশের দশকের পর থেকে গ্যেডেলের অসম্পুর্ণতা তত্ত্ব এসে যাওয়ার পরে, একটি তৃতীয় সম্ভাবনাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন গণিত-পথিকেরা – তা হল প্রামান্য বা অ-প্রামান্য কোনোটিই নয়। তাছাড়া অনিশ্চিতির আরো একটি কারন, গাণিতিক প্রমান পদ্ধিতিতেও বিভিন্নতার উপস্থিতি। একই গাণিতিক রূপ থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রমান

গাণিতিক প্রমান এক জাতীয় পদ্ধতি, বিগত এক শতকেরও বেশি সময় ধরে যার গ্রহনযোগ্যতা এবং মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্ঞানের অন্য ক্ষেত্রেগুলিতেও, পদার্থবিদ্যায় তো বটেই, এই পদ্ধতির প্রয়োগ এক লাফে সম্মান বাড়িয়ে তোলে। ‘Understanding means understanding through mathematics’, গণিতের অপর নাম র‍্যাশনালিটির অপর নাম গণিত। সকলেই জানেন অধিকাংশ গণিতজ্ঞের আচরন অস্বাভাবিক তবুও।

ফলে ‘বিজ্ঞানের রানী’ যে কোনো অন্য জ্ঞানের ‘পরিচারিকা’ ইয় পরিনতিলাভ। Non-standard analysis-কে অধ্যাপক William F. Tayor কি চোখে দেখেন তার নমুনাঃ That subject looks very interesting to me, and I wish I could take out the time to master it. There are numerous places in my field where one is confronted with the things that are going on simultaneously at totally different size scales. They are very difficult to deal with by conventional methods. Perhaps non-standard analysis with its infinitesimals might provide a handle of sort of things.

টেলর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন প্রথম সারির ব্যাক্তিত্ব। কোনো আশ্চর্য গণিতাংশকে প্রায়ই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় – ‘কী হবে এ দিয়ে?’
প্রশ্ন হয় না ; ‘কেমন লাগছে একে?’
কেন? কেন গণিতের অন্য নাম র‍্যাশনালিটি? ‘Quantitative science – that is science with mathematics – has proved successful in controlling nature. The majority of the society backs it up for this reason. At the present moment, they want nature to be altered and controlled – to the extent, of course, that we can do it and the results are felicitous. The humanist point of view is a minority point of view. But it is influencial – one sees this among young people’ – ১৯৭৭ – এর আগস্ট মাসে অধ্যাপক টেলরের এই সাক্ষাৎকার। আমি আরো লক্ষ করতে বলি ঐ ‘humanist point of view’ শব্দগুচ্ছকে।

কে কথা বলছে? ক্ষমতা। মেজরিটি প্রকৃতপক্ষে – ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, অথবা মেজরিটির অর্থ গতানুগতিকতা। টেলর-এর কাছে সুন্দর তখনই যখন তা কোনো ব্যবহারে লাগে। গণিত সুন্দর ততক্ষনই, রানী ততক্ষনই যতক্ষন তা ব্যবহার্‍্য।

গণিতকে বেরিয়ে আসতেই হবে এই স্তাবকতার তাহ থেকে, স্তাবকতার আড়ালে লুকোনো লোভী দৃষ্টি থেকে। বিজ্ঞাপন, বাজার, ব্যবসা ও ব্যবহারের বাইরে থেকে তার নিজের, শুধুমাত্র সৈন্দর্যের কোণতিতে তাকে ফিরতেই হবে। ব্যবহারিকেরা আসুন সবিনয়ে, মুগ্ধতা নিয়ে, এবং ভালোবেসে।

সমস্ত জ্ঞানের পদ্ধতির চুড়ান্ত শুদ্ধ রূপ গাণিতিক পদ্ধতি – এই বোধ ও বিশ্বাসে একটু ভাঙন ধরেছে ইদানীং। এর অন্যান্য কারনের মধ্যে, আমার মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্যতর হল, প্রচলিত গণিতের ভিত্তি ও পদ্ধতিতে গণিতের অন্তর্জগত থেকেই উদ্ভুত সন্দেহ। এই সন্দেহের মুখে দাঁড়িয়ে গণিত এতদিনকার অদ্বৈততা হারিয়ে ফেলছে। সে শতধারায় বিভক্ত- আমি বলতে চাই বিকশিত। বিকল্প গণিতেরা দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মূল স্রোতটি অবশ্যই অদ্বৈততার রক্ষক, কারণ স্পষ্টতই পায়ের তলার ভূমি। আর বিভিন্ন ক্ষীণ, অতিক্ষীণ, বিদ্রোহী, অবার্চীন ধারাগুলির ক্রমাগত আবির্ভাব। কা বাঁচে কে হারায় সে প্রশ্ন এই ক্ষণে অর্থহীন। ধারাগুলি যেন স্বাভাবিক পরিণতি পেতে পারে- সভ্যতার দায়ে এটুকুই হওয়া উচিত। তাকে যেন স্বাভাবিক জল-হাওয়া থেকে বঞ্চিত না করা হয়। এ দায়িত্ব পালন করছে কই সভ্যতা? আর এই যে যেটুকু আত্মপ্রকাশনার সুযোগ পাচ্ছে বিভিন্ন বিকল্প গণিত তার পিছনেও ঐ ব্যবসা- এবং ভবিষৎ ব্যবহার্যতার সম্ভাবনা- আমার বিশ্বাস তাই।

আমার কাছে একটা দায় এসে পড়ে। ‘আকাশকুসুম’ রচনার অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়। গণিতের মূল ধারা আকাশকুসুমকে স্বীকার করেও তার আকার-বর্ণ গন্ধের সীমানা সুনির্ধারিত করে দেয়। তাই অস্বীকার এই মূল স্রোতকে। আর রাষ্ট্র-সমাজ-ব্যবসা-টেকনোলজি-উপযোগিতার নিক্তিতে মাপছে সব কিছু। অবার্চীনতার সামান্য স্থান এখানে। অস্বীকার তাকেও, সে কারণে।

বস্তুত ক্রমাগত আকাশকুসুম রচনা করে করেই এই অস্বীকারের একটা বাস্তবতাও তৈরি হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top