বিধান রায়ের নাম করলে কোন পরিচয়টি আগে মনে আসে? চিকিৎসক, না কি বাংলার রূপকার মুখ্যমন্ত্রী? এককথায় তা বলা বোধহয় একটু কঠিন। আসলে বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব যাঁর একটি পরিচয় কখনও অন্যটিকে আড়াল করতে পারেনি। তিনিও সচেতন ভাবেই নিজেকে দু’দিকে মেলে ধরেছেন। তবু হয়তো চিকিৎসক পরিচয়ের প্রতি একটু বেশিই ‘পক্ষপাতিত্ব’ ছিল তাঁর। তাই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আগে অনায়াসে যুক্ত হয়ে যায় ‘ডাক্তার’। আজও বাঙালির সশ্রদ্ধ সম্বোধনে তিনি সংক্ষেপে ‘ডাক্তার রায়’।
জন্ম ও ছোটবেলা
বিহার রাজ্যের পাটনার বাঁকিপুরে ১৮৮২এর ১লা জুলাই বিধানচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রকাশ চন্দ্র রায় সরকারি কর্মচারি ছিলেন। মাতার নাম অঘোরকামিনী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে ছোটো ছিলেন বিধানচন্দ্র। প্রকাশচন্দ্র ও অঘোরকামিনী উভয়েই ছিলেন ধর্মপরায়ণ। সাধারণ জীবনযাপন হলেও উচ্চ আদর্শ ছিল। একসময়ে প্রকাশ খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। পরে ব্রাহ্মসমাজে যুক্ত হন। প্রসঙ্গত, বিধানচন্দ্রের নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। আচারসর্বস্বতার বদলে রোজ ঈশ্বরের উপাসনা-মন্ত্র পাঠ করার অভ্যেস বিধানচন্দ্রেরও ছিল। ঠাকুরমা নাম রেখেছিলেন ভজন।
শিক্ষা ও যৌবন
স্থানীয় গ্রাম্য পাঠশালায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর পাটনার টি.কে. ঘোষ ইনস্টিটিউশন এবং পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এরই মাঝে ১৮৯৬ এ প্রায় বিনা চিকিৎসায় মা’কে হারান তিনি। পরের বছরই তিনি এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাটনা কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। ১৯০১ সালে গণিতে সাম্মানিক সহ বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা চলে আসেন। পিতার সামান্য মাইনের চাকরিতে সংসার কোনোরকমে চলত। প্রবল অর্থাভাবের মধ্যে দিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন বিধান চন্দ্র।
ডাক্তারি পড়বার আলাদা কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁর। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্ম আগে আসায় আবেদন করে পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম যখন এলো, তখন তিনি ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেছেন।
মেডিক্যাল কলেজে বিধানচন্দ্র রায়ের ‘আদর্শ’ ছিলেন তাঁর অধ্যাপক কর্নেল লিউকিস। এই ইংরেজ শিক্ষকের কাছে জাতীয়তাবোধের শিক্ষাও পেয়েছিলেন বিধানচন্দ্র। কর্নেল তাঁর ছাত্রকে বলেছিলেন, “কোনও সাহেবের সামনে একবার একটু মাথা নোয়ালে তিনি তোমাকে দ্বিগুণ নত করতে চাইবেন!” বিধান সেটা বুঝে চলতেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় একবার কলকাতা থেকে তাঁরা দুই বন্ধু ট্রেনে বর্ধমানে যাচ্ছিলেন। এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতি তাঁদের কিছুতেই উচ্চশ্রেণির কামরায় উঠতে দেবেন না। শেষ পর্যন্ত বিধান মারলেন। ঘটনাটি সম্পর্কে পরে তাঁর মন্তব্য, “মনে হয়েছিল, আমরা যেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে ফেলেছি!”
আরও পড়ুন: রাজা রামমোহন রায় – নবজাগরণের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র
অল্প দিন পরেই অবশ্য আর একটি ‘যুদ্ধ’ লড়তে হল তাঁকে। সেটি তাঁর জীবনের একটি নির্মম বাঁক। একটি পথ দুর্ঘটনা থেকে এর সূত্রপাত। মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে পিক-এর ঘোড়ার গাড়িকে একটি ট্রাম ধাক্কা মারে। বিধানচন্দ্র রায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে অধ্যাপক পিক তাঁকে এই মামলায় সাক্ষী হতে বলেন। তিনি চেয়েছিলেন বিধান বলুন, দোষ ট্রামের। কিন্তু বিধান জানিয়ে দেন, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি দেখেছেন দোষ ঘোড়ার গাড়ির। তাই সাক্ষ্য দিতে হলে তিনি সেটাই বলবেন। অতএব জের গড়ায় এবং ‘এমবি’-র মৌখিক পরীক্ষায় পিক তাঁকে ‘পাস মার্কস’ দেন না।
অগত্যা অধ্যাপক লিউকিসের পরামর্শে এলএমএস পরীক্ষায় বসা। উত্তীর্ণ হয়ে মেডিক্যাল কলেজে কর্নেল লিউকিসের অধীনেই শল্য চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করলেন। প্রাইভেটেও রোগী দেখতেন দু’টাকা ভিজিটে। সঙ্গে চলতে থাকে এমডি-র জন্য থিসিস লেখা।
পরিকল্পনা, দু’বছরে এমডি হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে যাওয়া। মাত্র দু’বছরের মধ্যে ১৯১১-র মে মাসে বিধান একই সঙ্গে এফআরসিএস (শল্য চিকিৎসা) এবং এমআরসিপি (মেডিসিন) হওয়ার সম্মান অর্জন করেছিলেন।
বাংলার রূপকার হয়ে ওঠার কাহিনী
১৯১১-র জুলাইতে বিধানচন্দ্র রায় কলকাতায় ফিরে এখনকার মহাত্মা গান্ধী রোডে (তখন হ্যারিসন রোড) বাড়ি ভাড়া নেন। কাজের জন্য দেখা করেন তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের সার্জন জেনারেলের সঙ্গে। বাসনা, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপক হওয়া। বিধানচন্দ্র রায় তাঁর প্রাক্তন ছাত্রও বটে, কিন্তু তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপকের পদ শুধু ইংরেজদের জন্য।
বিধানচন্দ্রের ‘ভিআইপি’ রোগীদের তালিকায় ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, মতিলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ। একবার সরকারি কাজে আমেরিকায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট কেনেডির ডাকে তাঁর পিঠের ব্যথা সারিয়ে দিয়েছিলেন বিধান। এমনকি, কেনেডির ডাক্তার তাঁকে যে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করছিলেন, সেটি কানে দিয়েই বিধানচন্দ্র রায় বলে দিয়েছিলেন, যন্ত্রটি খারাপ!
ক্যাম্বেলে ১৯১৯ পর্যন্ত কাজ করার পরে হঠাৎ কারমাইকেলে (এখন আরজিকর) মেডিসিনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসে বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। তিনি রাজি হলেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কারমাইকেল মেডিক্যাল স্কুলকে কলেজে উন্নীত করবে। বিধান রায় সেখানে যোগ দিলেন। কারমাইকেল স্কুল তৎক্ষণাৎ মেডিক্যাল কলেজ হয়ে গেল। যখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী, তখনও তিনি ছিলেন এই মেডিক্যাল কলেজের ‘ছুটিতে থাকা, বেতনহীন’ অধ্যাপক।
আরও পড়ুন: বুদ্ধিমান কাক : একটি শিক্ষামূলক গল্প
স্বাধীনতার পরে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছায় এক অস্থির সময়ে মুখ্যমন্ত্রী হন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। দেশভাগের ক্ষত, ওপার বাংলা শরণার্থীদের স্রোত, রাজ্যে কর্মহীনতা, আর্থিক চাপ, খাদ্য সঙ্কট সব মিলিয়ে সরকার তখন নাজেহাল।
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন স্বাধীনতার পাঁচ মাস পরে, ১৯৪৮-এর ২৩ জানুয়ারি, ঘটনাচক্রে যা সুভাষচন্দ্রের জন্ম দিন। ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরেও চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের মাসিক আয় ৪২ হাজার টাকা। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার।
কলকাতার উপরে চাপ কমাতে কল্যাণী ও সল্ট লেক উপনগরীর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ, ব্যান্ডেল ও দুর্গাপুরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ, হরিণঘাটা সরকারি দুগ্ধ প্রকল্প প্রভৃতি তাঁর আমলের। দুর্গাপুরে ইস্পাত কারখানা ও শিল্প নগরী গড়ে উঠেছে বিধানচন্দ্রের উদ্যোগে। ডিভিসি, দুর্গাপুর ব্যারাজ ইত্যাদি আদতে তাঁরই ভাবনার ফসল।
আবার তাঁরই উৎসাহে বহু বড় বড় বেসরকারি শিল্পের প্রসার হয়েছিল বাংলায়। হিন্দুস্থান মোটরস, সেন-র্যালে দে’জ মেডিক্যাল, গ্লুকোনেট প্রভৃতি রয়েছে সেই তালিকায়। দীর্ঘ দিন রাজ্যে কর্মসংস্থানের এক একটি ঠিকানা ছিল এই সব শিল্প কারখানা। রাজ্যে জ্বালানি তেল শোধনাগারের স্বপ্নও প্রথম দেখেছিলেন তিনি, পরে যার বাস্তবায়ন হলদিয়া শোধনাগার। বিকল্প একটি নদী-বন্দরের ভাবনাও ছিল তাঁর।
কর্মপ্রাণ এই মানুষটিকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হয় ১৯৬১ সালে। শরীর তখন অসুস্থ। হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা ধরা পড়েছিল একাধিকবার। কাজ তবু কমাননি। ১৯৬২ সালের ১ জুলাই জন্মদিনের ভিড় তাঁর ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে, ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।