পরিমল হেমব্রম
আশ্বিন মাস সাঁওতাল জনজীবনে অন্যমাত্রা নিয়ে আসে কেন না এই মাসেই অনুষ্ঠিত হয় তাদের অন্যতম প্রধান উৎসব বা পরব দাঁশায়। এ কারনেই আশ্বিন মাসকে সাঁওতালরা “দাঁশায় বঙ্গা” অর্থাৎ দাঁশায় মাস বলে থাকে।
সাধারানত এই মাসে প্রকৃতির কোল জুড়ে সবুজের সমারোহে মনে খুশির হিমেল আভাস থাকলেও প্রসন্ন প্রকৃতির ছায়ামাখা ভুখন্ডে ভূমিপুত্ররা “দাঁশায়” এর আবেশে আচ্ছন্ন হলেও খুশীর হিন্দোলে দোল খাওয়ার মানসিকতা তাদের থাকে না কারন “দাঁশায়” তাদের কাছে দুঃখের পরব হিসেবে চিহ্নিত। দুঃখের পরব দাঁশায়। তাই তো সাঁওতাল অধ্যুষিত পল্লীতে পল্লীতে ধ্বনিত হয় “হায় হায় হায়রে হায়” সুরের করুন রেশ। দাঁশায় পরবের সমস্ত গানের শুরুতেই স্বজন হারানোর এই ব্যাথা মথিত আকুতির মুর্ছনা ঝংকৃত হয়। দুঃখের মাঝেই যেমন থাকে সুখের পরশ, ব্যাথার মধ্যে খুশীর, তেমনই দাঁশায় পরবও পালন করা হয় দুঃখের মাঝে সুখের স্পর্শানুভুতির মধ্য দিয়ে। ব্যাথা মলিন মনে আনন্দময় হাসির মধ্য দিয়ে। তাই তো দলবদ্ধ মানুষ গান গায় নাচে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আশ্বিনের হিমেল হাওয়ায় কাশফুলের দোলা মনের মধ্যে মায়ের আগমন বার্তা জানিয়ে দেয় তখনই সারা বাংলা তথা পূর্ব ভারত আনন্দে মেতে ওঠে। সবুজ প্রকৃতির পল্লী ও কংক্রিটের শহর সর্বত্রই দুর্গাপূজোকে কেন্দ্র করে খুশীর আমেজ বয়ে বেড়ায়। এমনই খুশীর উৎসবে প্রতিবেশী সাঁওতাল সমাজে দেখি অন্য চিত্র। এখানে পালন করা হয় দুঃখের উৎসব। দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন থেকে দাঁশায় নাচ। বিজয়া দশমীতে শেষ হয়।
এই প্রবের নৃত্যগীতে প্রধান বিশেষত্ব হল এতে কেবল পুরুষেরাই অংশ গ্রহণ করে এবং এতে বয়সের তারতম্য বাধার সৃষ্টি করে না। অপর বিশেষত্ব হল-গীত সহযোগে নৃত্যে পুরুষেরা মহিলাদের পোষাকে সজ্জিত হয়। যদিও শাড়ী পরা হয় ধুতির মতোন করে। ব্লাউজ থেকে শুরু করে অন্যান্য মহিলা-অলঙ্কারাদিও ব্যবহৃত হয়। তৃতীয় বিশেষত্ব হল-“ভুয়াং” বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যা দাঁশায় ছাড়া সাঁওতাল জনজীবনের অন্য কোন পরবে ব্যবহৃত হয় না। “ভুয়াং” হল ধনুক আকৃতির বাদ্যযন্ত্র বিশেষ। ধনুকের মাঝ বরাবর যেখানে তির রেখে জ্যা যুক্ত করা হয়, ঠিক ঐ জায়গায় অর্থাৎ জ্যা-এর ঠিক বিপরীতে বড় আকারের শুকনো লাউ-এর খোল বিশেষ উপায়ে লাগানো থাকে। এবার জ্যা ধরে টান দিয়ে ছেড়ে দিলে অদ্ভুত মন মাতানো সুরের সৃষ্টি হয়। ভুয়াং ধবনির নির্দিষ্ট ছন্দে নাচ ও গানে যে সব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় তা হল – বাঁশী, বানাম (বেহালা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ), কাঁসার থালা (ঘন্টার মতো করে বাজান হয়)। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন – “ভুয়াং” কে মূল বাদ্যযন্ত্র রেখে বাঁশী, বানাম, কাঁসার থালা সহযোগে যে দাঁশায় নাচ ও গান নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে বলা হয় “ভুয়াং নাচ”। অপর দিকে ধামসা, মাদলকে মূল বাদ্যযন্ত্র রেখে বাঁশী, বানাম, করতাল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহযোগে যে দাঁশায় নাচ ও গান নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে বলা হয় “লবয়” ।
উভয় ক্ষেত্রেই নিজস্ব ভঙ্গী অনুযায়ী দাঁশায় গান ও নাচের ছন্দ ঘণীভুত হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দাঁশায় নাচের ভিন্ন ভিন্ন তালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নর্তকের শরীর ছন্দও হয় ভিন্ন ভিন্ন। অপর দিকে গানের মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র। যেমন – কোন কোন গানে ফুটে উঠেছে দুঃখের ব্যাথা ভরা কাহিনি, কোনটাতে বা রাজার যুদ্ধের প্রসঙ্গ আবার কোন কোন গানে রয়েছে প্রকৃতি বন্দনা, সৃষ্টি কাহিনী এমন কি সাঁওতাল জনজীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত স্থান এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য বস্তুরও উল্লেখ রয়েছে দাঁশায় গানে।
অনেকে মনে করেন, দাঁশায় গানে সাঁওতাল জাতীর ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। জাতীর উৎস সন্ধানে দাঁশায় গান সহায়াক। এখানে একটা গানের উল্লেখ করা হল –
” হায়রে হায়রে
তকা দিশম ধুঁদেনা হায়রা হায়
তকা দিশম মালটেনা হায়রা হায়
দিশম দ দিশম লেলেঁগেৎ–
হায়রে হায়
তুড়ুক দিশম ধুঁদেনা হায়রা হায়
‘গাঁগি চাঁওরিচ’ মালটেনা হায়রে হায়
দিশম দ দিশম লেলেঁগেৎ।”
এই গানের ভাবার্থ এ রকম – কোন দেশ অন্ধকার হল। কোন দেশ ধ্বংস হল। ‘গাঁগি চাঁওরিচ’ দেশ ধ্বংস হল। গানটিতে “গাঁগি চাঁওরিচ” দেশের উল্লেখ রয়েছে। এই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানা যায় না। ইতিহাসেও এর কোনও উল্লেখ নেই। সাঁওতালদের সঙ্গে এদেশের সম্পর্ক কি কিংবা এই দেশের বাসিন্দারাই বা কারা? এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে সাঁওতাল জাতীর ইতিহাস সন্ধান হয়তো সহজ হত। এহো বাহ্য।
সাঁওতাল জনজীবনের অন্যতম উৎসব দাঁশায় যা দুঃখের পরব হিসেবে চিহ্নিত। এর অন্তরালে যে কাহিনী প্রচলিত তা এই রকম –
এক রাজা নাম তার দুরগা। প্রচন্ড শক্তিশালী এই রাজা মায়াবলে বিভিন্ন রুপ ধারন করতে পারত। যেমন, অনাবৃষ্টির সময়ে মেঘের রুপ ধারন করে বৃষ্টিপাত ঘটাত,। যুদ্ধের সময় কালোমেঘের ভেতরে প্রবেশ করে তা থেকে শিলাবৃষ্টি রুপে আক্রমন করে শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করত। এছাড়াও বিভিন্ন ভয়ংকর জন্তু জানোয়ারের রুপ অনায়াসে ধারন করে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে হারিয়ে দিত। এ সবের কারনে রাজা ‘দুরগা’ কে সকলেই সমীহ করত। ভয় পেত। কিন্তু রাজার এক মস্তবড় গুন ছিল তা হল কোন অবস্থাতেই মহিলাদের আক্রমন করত না বা তাদের ক্ষতি করত না। মহিলাদের প্রতি রাজার এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর প্রয়াসে শত্রুপক্ষ একজোট হয়ে দুজন মহিলাকে ‘দুরগা’র বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য পাওয়া যায়। একজনের নাম “লাংতিতি লুখী”, অপর মহিলার নাম “দিবি”। ভয়ংকর যুদ্ধে দুই মহিলাই পরাস্ত হয় এবং তাদের বন্দি করা হয়। পরে রাজা ‘দুরগা’ দিবিকে সসম্মানে স্ত্রীর আসন অলংকৃত করার প্রস্তাব দেয়। ‘দিবি’ সম্মতি জানায়। আসলে, দুরগাকে স্বামী হিসাবে স্বীকার করার অন্তরালে রয়েছে দুরগা নিধন। দিবি তাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। ঘটনাচক্রে, একদিন রাজা দুরগা আবেগবশতঃ ‘দিবি’ কে তার মহিষরুপ ধারনের গোপন ক্ষমতার কথা জানায় এবং এ নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। খেলাটি এই রকম – রাজা দুরগা তার মায়াবলে মহিষরুপ ধারন করে মহিষদলের ভিড়ে মিশে যাবে। এরই মাঝখান থেকে দিবি তাকে চিনতে পারবে কিনা – এই খেলা শুরু হয়।
হাতে চাঁদ পেল দিবি কেননা সে এই ধরনের সুযোগের অপেক্ষাতেই দিন গুনছিল। খেলা শুরু হল। চলতে থাকে। দিবি আসলটিকে চেনার চেষ্টা করে। একদল মহিষের মাঝে দুরগাকে চিনতে পেরে এবং পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অস্ত্রের এক কোপে মহিষরুপী দুরগার মুন্ডকে ধড়হীন করে দেয়। রাজা দুরগার মৃত্যু হয়।
এরপর থেকে ‘দিবি’-র পরিচয় হয় ‘ঠাকরান ‘ বা ‘দেবী’ নামে। এরপর থেকেই আতঙ্ক ছেয়ে গেল সর্বত্র। দুরগা নিধনের পর অজ্ঞাত কারনে দেবী সমস্ত পুরুষদের একের পর এক হত্যা করতে লাগল। হাহাকার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আকাশে বাতাসে। দেবীর ক্রোধাগ্নী থেকে মহিলারা পরিত্রান পাওয়ায় পুরুষেরা প্রাণভয়ে মহিলাদের পোষাক পরিধান করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।
গল্পের শেষ এখানেই। মহিলাদের পোষাকে সজ্জিত হওয়ার অন্তরালে এই কাহিনী ছাড়াও অন্য কাহিনী সাঁওতাল জনজীবনে প্রচলিত। পরিশেষে বলা যায়, দাঁশায় নাচের জন্য এক একটি গ্রামের পুরুষেরা একত্রিত হয়ে এক একটি দল তৈরী করে। এভাবে অসংখ্য দল গ্রাম থেকে গ্রামে নৃত্যগীত পরিবেশন করে এবং বিনিময়ে রীতি অনুযায়ী দলকে ঘর পিছু চাল দেওয়া হয়।
ইদানিং রাজনৈতিক কারনে গ্রামের একতা ভঙ্গ হওয়াতে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবক্ষয় শুরু হয়েছে। এর রক্ষা কবচ সম্পর্কে সাঁওতাল বুদ্ধিজীবিদের চিন্তা করার সময় এসেছে।