স্যার ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) একই জীবনে বহু কিছু ছিলেন। আইনবিদ, রাজনীতিক, দার্শনিক, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, বিজ্ঞান অনুরাগী, ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ এবং সম্রাট প্রথম জেমসের উপদেষ্টা আর বিতর্কিত অথচ অসাধারন এক ব্যাক্তিত্ব। তাঁর সময়ে ও তার পরে বহু প্রশংসা অতি প্রশংসা ও নিন্দার লক্ষ হহেছেন তিনি। বেন জনসন, যিনি বেকনকে জানতেন, তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন ‘তার লেখার ও কাজকর্মের বিচার করলে আমার মনে হয় সে অকেন যুগের সবথেকে প্রশংসনীয় সেরা মানুষদের একজন।’ আবার আইজাক ওয়ালটন তার সম্বন্ধে বলেছেনঃ ‘তিনি ছিলেন বিশ্ব প্রকৃতির একজন বিশ্বস্ত সহচর ও অনুলেখক ।’ কিন্তু পরের শতকেই আলেকজান্ডার পোপের তীক্ষন কলম বোধহয় বেকন সম্বন্ধে শেষ কথা বলে গেছে –
‘মানুষের মন আর মননের গভীর অতল
কেমনে তা ছুঁতে হয় যদি নাই শিখে থাকো
চেয়ে দেখো, সামনে উদাহরন রয়েছেন
মেধাবী বেকন ।
সব থেকে জ্ঞানী আর উজ্জ্বল মানুষ একজন,
বিকীর্ণ করেছেন আলো,
যদিও সবার থেকে ছোট তার মন’।
(If parts allure thee, think how Bacon shined,
The wisest, brightest, meanest of mankind)
ইংল্যান্ডের রাজসভায় উচ্চপদস্থ সভাসদ স্যার নিকোলাস বেকনের পুত্র ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon) ১৫৮২ সালে আইনবিদ্যায় শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং অল্প দিনের মধ্যে পার্লামেন্টে আসন পান (১৫৮৪) । কিন্তু স্যার নিকোলাসের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাননি অথচ তিনি বেশ অমিতব্যায়ী ছিলেন। এর ফলে চিরকালই তাঁকে টাকা পয়সার অভাবে ভুগতে হয়েছে। পার্লামেন্টের প্রবেশে অল্প দিনের মধ্যে তিনি রানির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সভাসদ আর্ল অফ এসেক্সের সহযোগি ও বন্ধু হয়ে ওঠেন। ১৬০১ সালে আর্ল রানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং বিচারে আর্লের প্রানদন্ড হয়। বেকন তাঁর বন্ধুর বিচারে তার বিপক্ষে এবং এই শাস্তি হওয়ার পক্ষে কাজ করেছিলেন। এটাকে হয়ত সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতার থেকেও অসম্মানজনক কিছু বলা উচিৎ। এই ঘটনার কালো ছায়া বেকনের উপর চিরকাল ছিল ও থাকবে। তিনি সম্ভবত বন্ধুত্বের থেকে রাজ আনুগত্যকে বেশি বড় মনে করেছিলেন। যাই মনে করে থাকুন, এই অমানবিকতার জন্য ইতিহাস তাঁকে ক্ষমা করেনি ও করবেওনা ।
এরপর বেকন ক্ষমতা অর রাজসম্মানের শিখর থেকে শিখরে পৌঁছেছিলেন। ১৬০৩ সালে তিনি নাইট উপাধি পান, ১৬১৮ সালে ব্যারন হন, ১৬২১ সালে সেন্ট আলবান-এর ভাইকাউন্ট। এরই সঙ্গে তিনি সলসিটর জেনারেল, এ্যাটর্নি জেনারেল, লর্ড কীপার এবং পরে লর্ড চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। লর্ড চ্যান্সেলর ছিল বিচার বিভাগের সর্ব্বোচ্চ পদ, অনেকটা সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির মত। এরপরেই ১৬২১ সালেই তাঁর পতন ও সম্মান হারানোর পালা। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, অবশ্য তাঁর স্বীকারক্তিতে তিনি বলেন যে উপঢৌকন নিলেও তার দ্বারা তাঁর সিধান্ত প্রভাবিত হয়নি। তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়নি কিন্তু রাজার সভাসদ হিসেবে তাঁর রাজনীতিকে জীবনের এখানেই ইতি টানতে হয় বলা যায়।
এরপর তিনি সম্পূর্ণভাবেই মনন চিন্তন ও লেখালেখির মধ্যে আত্মনিয়োগ করেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ও সম্ভাবনার প্রবক্তা হিসেবে শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হয়। বেকনকে বলা হত ‘philosopher of utilities’। ব্যবহারিক জগতের দার্শনিক, জাগতিক জ্ঞান ও বুদ্ধির আশ্চর্যজনক আকর তাঁর রচিত প্রবন্ধসমূহ, এত গল্প কথায় ব্যবহারিক চিন্তার এত দিক, এত দিগন্ত উন্মোদিত করেছেন তিনি, যে অবাক হতে হয়। তাঁর রচিত প্রবন্ধ সংগ্রহের তিনটি সংস্করণ বের হয়। প্রথমটি ১৫৯৭তে, তাতে মাত্র ১০টি লেখা ছিল। দ্বিতীয়টির প্রকাশ হয় ১৬১২ সালে ৩৮টি রচনা নিয়ে। আর তৃতীয় ও শেষ সংস্করণে ৫৮টি লেখা ছিল। তাঁর মৃত্যুর অল্প দিন আগেই তা শেষ হয়। জ্ঞান ও বুদ্ধি নিয়ে চর্চা করতে করতেই বেকন তাঁর জীবনের শেষ দিনে পৌঁছান।
তখন বোধ হয় তিনি জাগতিক উচ্চাশার মোহজাল থেকে মুক্ত একজন মানুষ হতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধসমূহ থেকে তিনটির অনুবাদ এখানে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছেঃ বন্ধুত্ব (Of Friendship), উচ্চপদে কর্তব্য এবং অকর্তব্য (Of Great Place) ও পাঠ-অভ্যাস (Of Studies)।