চিলির আটাকামা মরুভূমিতে ইয়রেটা নামক হাজার বছরের পুরনো ঘন ঝোপঝাড় আছে, যা দেখে মনে হয় পাথরের উপর শ্যাওলা জমে আছে। আসলে এটি ডালপালা এবং পাতার একটি গুচ্ছ যা এত শক্ত যে এর উপর বসা বা শোয়া পর্যন্ত যায়।

ইয়রেটা – Iiareta বা Yareta : কি এগুলি ?
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা আন্দিজ। দৈর্ঘে ৭ হাজার এবং প্রস্থে ৫০০ কিলোমিটার, গড় উচ্চতা ১৩ হাজার ফুট। আন্দিজের বিবর্ণ ধূসর রঙা উপত্যকার রুক্ষ পাথুরে জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাশি রাশি উজ্জ্বল পান্না সবুজ ঢিপিগুলির দেখা পেয়ে আনন্দে নেচে ওঠে বহিরাগত পর্যটক বা অভিযাত্রীদের মন। মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যানের দেখা পেলে বেদুইনদের মনে যেমন অপরিসীম আনন্দের সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনই ।
আলগা পাথর, রুক্ষ পাথুরে মাটির মধ্যে উজ্বল সবুজ গোলাকার মসৃণ বোল্ডারগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ যেন নরম মখমলের ঢাউস কুশন পেতে রেখেছে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য। পাথরের গায়ে কি তাহলে সবুজ শ্যাওলা জমেছে! ছুটে গিয়ে ছুঁতে চান অভিযাত্রীরা।
কাছে গিয়েই ভুলটা ভাঙে। দেখতে সেরকম মনে হলেও, আদৌ মখমলের মত নরম নয়। সবুজ গোলাকার ঢিপিগুলি পাথরের মত শক্ত ও নিরেট। অনেকটা ঠিক এঁচোড়ের গায়ের মতো। আঙুল দিয়ে চাপ দিলে আঙুল ডোবেই না। কী এগুলো! বিস্ময়ে অবাক হয়ে যান পর্যটক থেকে অভিযাত্রীরা। একটা পূর্ণ বয়স্ক মানুষের যদি এসে শুয়ে পড়েন একটি সবুজ বোল্ডারের ওপর। বোল্ডারগুলি এতটাই শক্ত ও এতটাই নিরেট যে একটুও বসে যায় না।

একটা ছুরি দিয়ে এই সবুজ বোল্ডারের মত দেখতে বস্তুটির একটা অংশ কেটে নিয়ে ওই অংশে আগুন দিলে তা সহজেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। তবে এটা কোন ভাবেই পাথরে আগুন নয় অর্থাৎ এর নীচেও কোনও পাথর নেই। আমরা যাকে সবুজ বোল্ডার বলে উল্লেখ করছিলাম তা আসলে এক একটি গাছ। যাদের বয়স প্রায় ৩০০০ বছর বা তারও বেশি । চিরসবুজ এই গাছটির নাম ইয়রেটা। বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাজোরেলা কমপ্যাক্টা। পৃথিবীর দীর্ঘজীবী উদ্ভিদগোষ্ঠীদের মধ্যে অন্যতম হল এই ইয়রেটা।
চিলির অত্যন্ত শুষ্ক আটাকামা মরুভূমি, বলিভিয়া, পেরু ও পশ্চিম আর্জেন্টিনায় মূলত এদের বাস। আন্দিজ পর্বতমালার সাড়ে ১০ থেকে প্রায় ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় এই উদ্ভিদদের দেখা মেলে। জনমানবহীন ওই স্থানগুলিতে রৌদ্রস্নাত দিনের তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি। রোজ রাতে তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নেমে যায়। অত্যন্ত শীতল, শুষ্ক, বৃষ্টিহীন এলাকায় এরা টিকে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে।
অনুর্বর মাটি, বেশি পরিমাণ অ্যাসিড বা ক্ষার যুক্ত মাটি, জল দাঁড়ায় না এমন মাটিতেই জন্মায় আজব উদ্ভিদ ইয়রেটা। মাটির একেবারে কাছাকাছি জন্মায় ইয়রেটা। যেখানকার তাপমাত্রা পরিবেশের গড় তাপমাত্রার চেয়ে এক দুই ডিগ্রি থাকে মাটির ফিরিয়ে দেওয়া তাপের কারণে। ইয়রেটা বৃদ্ধি হয় খুবই মন্থরগতিতে। প্রতি বছর গড়ে মাত্র দেড় সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। জানলে অবাক হতে হয়, Apiaceae পরিবারের এই সপুষ্পক উদ্ভিদটির আত্মীয়দের মধ্যে রয়েছে আমাদের অতি পরিচিত পার্সলে আর গাজর গাছ। যদিও চেহারা, আকৃতি ও চরিত্রে ভগ্নাংশের মিলও নেই।
আরও পড়ুন: বাংলা ভাষায় প্রথম ঔপন্যাসিক ও ভাষাবিদ প্যারীচাঁদ মিত্র
পাথরের মতো শক্ত কেন সবুজ ইয়রেটা?
সমস্ত পর্যটকের মনেই একই প্রশ্ন থাকে কারণ এরকম গাছের কথা সত্যই কেউ শোনেননি। তাই বলতে হয় ইয়রেটার কাণ্ডের ওপরে লক্ষ লক্ষ ছোট পাতা ও কুঁড়ি একেবারে গায়ে গায়ে জমাট বেঁধে আছে। সবুজ ফুলকপি বা ব্রকোলির ওপরটা যেমন নিরেট মনে হয় এই গাছের চারদিকটা তেমনই নিরেট মনে হয়।
কাণ্ড দেখা যায় না – কিন্তু কেন!
আসলে চরম আবহাওয়ায় টিকে থাকতে গেলে নিরেট হওয়া ছাড়া এদের উপায় ছিল না। মাটিতে জলের ভয়ংকর অভাব, যাতে শরীরের জল বাষ্প হয়ে বেরিয়ে না যায় তাই পাতাগুলি গায়ে গায়ে জুড়ে থাকে। লম্বা হলে প্রবল হাওয়া মূলশুদ্ধ গাছকে উপড়ে দেবে, তাই উচ্চতায় না বেড়ে পাশাপাশি বেড়ে হাওয়াকে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেয় বুদ্ধিমান ইয়রেটা। গোলাপি ও ল্যাভেন্ডার রঙের ছোট ছোট ফুল হয়। একই গাছের পুরুষফুল ও স্ত্রী ফুলের মধ্যে পরাগমিলন ঘটায় পতঙ্গ।
ইয়রেটারা – এখন কেমন আছে !
কদিন থাকবে জানি না। সহজে জ্বালানো যায় বলে প্রাচীন কাল থেকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ও বৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম হওয়ার জন্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে ইয়রেটারা। গাছগুলিকে যদিও সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে, তবে আমার মনে হয় এরা আর বেশি দিন নেই।