বোধিসত্ত্ব বা জাতকের গল্প আসলে ভগবান বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্মের গল্প। এই অপূর্ব সদর্থক নীতিশিক্ষামূলক গল্পগুলির মাধ্যমে বুদ্ধদেব অনুগামীদের শিক্ষা দিতেন
বোধিসত্ত্ব শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, বুদ্ধত্ব (শাশ্বত জ্ঞান) প্রাপ্তিই যাঁর ভবিতব্য অর্থাৎ যিনি বোধিলাভ করার জন্যই জগতে আবির্ভূত হয়েছেন। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শাখায় বোধিসত্ত্বের বহুবিধ ব্যাখ্যা থাকলেও মহাযান বৌদ্ধধর্ম মতে বোধিসত্ত্ব হলেন তিনিই যিনি জগতের কল্যাণার্থ স্বয়ং নির্বাণলাভ থেকে বিরত থাকেন এবং বিশ্বের সকল জীবের মুক্তিলাভের উপায় করেন। আসলে বোধিসত্ত্ব বুদ্ধদেব শিষ্যদের উপদেশ দিতেন গল্পচ্ছলে। বলতেন তাঁর বুদ্ধ হয়ে জন্ম নেওয়ার আগেকার সব জন্মজন্মান্তরের কাহিনী।
1. ধার্মিক রাজা
পুরাকালে বোধিসত্ত্ব একবার মহারাজ ব্রহ্মদত্তের পুত্ররুপে জন্মগ্রহণ করেন। ষোলো বছর বয়সে তক্ষশীলার পাঠ শেষ করে রাজ্যে ফিরে আসলে তিনি যুবরাজ হিসাবে বাবার রাজকার্যে সাহায্য করেন। মহারাজের মৃত্যুর পর বোধিসত্ত্ব রাজা হলেন। ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি রাজ্য চালাতে লাগলেন। একদিন একজন বিশিষ্ট রাজকর্মচারী একটি অপরাধ করে। রাজা বোধিসত্ত্বের কানে এই খবর যাওয়া মাত্রই বোধিসত্ত্ব ঘটনার সত্যতা যাচাই করে জানতে পারলেন যে, লোকটি সত্যি সত্যি অপরাধ করেছে। তখন রাজা বোধিসত্ত্ব কর্মচারীটিকে নির্বাসন দিলেন।
কর্মচারীটি দেশ ছেড়ে অন্য আর এক রাজ্যে গিয়ে সেই রাজ্যের রাজার কাছে আশ্রয় নিল, এবং মনে মন প্রতিজ্ঞা করলো যে ভাবেই হোক এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই হবে।
কর্মচারীটি প্রতিদিন রাজাকে কুবুদ্ধি দিতে থাকে। বলে, ‘ মহারাজ আমি জানি উনি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হচ্ছেন।’
মহারাজা জিজ্ঞেস করেন, ‘ আচ্ছা, সৈন্যবাহিনী কিরকম আছে?’
‘ ভয় পাওয়ার মতন কিছু নেই মহারাজ, যুদ্ধে আপনারই জয় হবে।’
রাজা দু-একবার পরীক্ষা করে বোধিসত্ত্বের মনোভাব জানবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে কোনওরকম সাড়া পেলেন না। একদিন তিনি বারণাসির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, প্রধান সেনাপতির কানে এই খবর যাওয়ামাত্রই প্রধান সেনাপতি রাজাকে রাজ্য আক্রমণের কথা বললেন। এতবড় একটা সংবাদ শুনে রাজা বোধিসত্ত্ব কিন্তু বিচলিত হলেন না। তিনি সমস্ত সমস্ত সৈন্যবাহিনী সহ আমত্যবর্গকে যুদ্ধে বিরত থাকবার জন্য আদেশ দিলেন। ফলে ওই রাজ্যের রাজা অতি সহজেই বোধিসত্ত্বকে বন্দী করলেন।
বোধিসত্ত্ব কিন্তু তাতেও বিচলিত হলেন না। তিনি কয়েদখানায় বসে রাজাকে অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিলেন, ধর্মকথা শোনালেন। কিন্তু ওই রাজ্যের রাজা বোধিসত্ত্বের কথা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে উড়িয়ে দিলেন, আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই রাজার গায়ে আগুন ধরে গেল। একজন রাজকর্মচারী বললেন, ‘ মহারাজ, ধার্মিক রাজাকে আক্রমণ করায় এই অবস্থা হয়েছে আপনার।’
রাজা সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্বকে মুক্ত করে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন এবং তাকে সসম্মানে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন।
আর পড়ুন: মোল্লা নাসিরুদ্দিন বা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প পর্ব-২
2. মরা ইঁদুর
সেই যে-বার তিনি বারানসীর এক বিখ্যাত বণিক বোধিসত্ত্ব হয়ে জন্মেছিলেন, অসাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধির জন্য তাঁর তখন খুব নামডাক হয়েছিল, তো, সেই জন্মের একটি অভিজ্ঞতার কথা বুদ্ধদেব একদিন তাঁর শিষ্যদের কাছে বলেছিলেন…
গল্পে বণিক বোধিসত্ত্ব একদিন রাজপথ দিয়ে রথে চেপে যাচ্ছিলেন রাজবাড়ি। হঠাত পথের পাশে দেখতে পেলেন পড়ে আছে একটা মরা ইঁদুর। তাই দেখে তিনি আপন মনে বললেন, কারও যদি বুদ্ধি থাকে, বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর উদ্যম থাকে, তাহলে এই মরা ইঁদুরটা দিয়েই সে জীবনে কিছু করে উঠতে পারবে।
বোধিসত্ত্বের রথের পাশ দিয়ে তখন যাচ্ছিল শহরের এক যুবক। সে শুনতে পেল বোধিসত্ত্বর স্বগত কথা। শুনে ভাবল, বোধিসত্ত্ব তো আলটপকা কথা বলার লোক নন, ইনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই এই ইঁদুরটা দিয়ে সত্যিই জীবনে কিছু একটা করে ওঠা যাবে। তাছাড়া বুদ্ধি আর উদ্যম তো তার আছেই। একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না কি হয়।
এসব ভেবেটেবে সে ইঁদুরটা পথের পাশ থেকে হাতে নিল তুলে। তারপর হাঁটতে শুরু করল শহরের এক গলি পথ দিয়ে। এদিকে হয়েছে কি, সেই গলিতেই এক মহাজন তার পুষ্যি বেড়ালের জন্য বেরিয়েছে খাবার খুঁজতে। তাই যুবকের হাতে বেড়ালের প্রিয়খাবার ইঁদুরটা দেখে মহাজনের খুশি আর ধরে না, সে অমনি কটা পয়সা দিয়ে ইঁদুরটা কিনে নিল যুবকের কাছ থেকে। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো পয়সা কটা পেয়ে যুবকও খুব খুশি হল। ভাবল, বাঃ বেশ হল তো! মরা ইঁদুর দিয়ে এই যে পয়সা কটা রোজগার হল, দেখা যাক তো, তাই দিয়ে কিছু করা যায় কি না!
এই না ভেবে, সেই পয়সা ক’টা দিয়ে সে কিছু গুড় আর ছাতু কিনে ফুলবনের পথের ধারে গিয়ে বসল। অবেলায় সেই পথে ফুল তুলে ঘরে ফিরতে লাগল মালিদের দল। সারাটিদিন তারা বনে বনে ঘুরে খিদেয় তেষ্টায় খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সেই যুবক যখন তাদের ছাতু, গুড় আর জল খেতে দিল, তখন মালিরা খুব খুশি হল। খুশি হয়ে তারা কিছু কিছু ফুল উপহার দিল যুবককে। সেই ফুল বেচে যুবকের গুড় ছাতুর কখরচের চেয়ে লাভ হল প্রায় দ্বিগুণ।
সেইসঙ্গে যুবকের কপালগুণেই বোধ হয় সেদিন বিকেলে আকাশ কালো করে খুব ঝড় উঠল। সেই ঝড়ে রাজার বাগানের বড় বড় গাছের ডাল গেল ভেঙে। কাজেই বাগানের মালির মাথায় পড়ল হাত। এত ডালপালা সে সরাবে কেমন করে! তখনই কোথা থেকে খবর পেয়ে যুবকটি হাজির হল গিয়ে সেই মালির কাছে। মালিকে বলল, মালিভাই, তোমার কোন চিন্তা নেই, ভাঙা ডালপালাগুলো যদি বিনিপয়সায় আমায় দিয়ে দাও, তাহলে বাগান পরিষ্কারের ভার আমার।
তাই শুনে মালি যেন হাতে চাঁদ পেল। সে তক্ষুনি বেজায় খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল। তখন যুবকটি করল কি, কয়েক পয়সার গুড় কিনে গেল পাড়ার ছেলেদের কাছে। গুড় খাইয়ে বাগান পরিষ্কারের কথা বলতেই অমনি তারা এক পায়ে খাড়া। নিমেষের মধ্যেই নাচতে নাচতে তারা ভাঙা ডালপালা সব জড়ো করে ফেলল এক জায়গায়। অন্যদিকে এক কুমোর তখন পড়েছে বিপদে। সে তো পোয়ানে হাঁড়ি পোড়াবে বলে পোয়ান সাজিয়ে তৈরি, কিন্তু ঘরে তার একটাও ডালপালা নেই। এবার কি করবে সে ভেবে পায় না কিছুতেই। এমন সময় সে একজন লোকের কাছে খবর পেল যে, রাজার বাগানে প্রচুর ডালপালা এক যুবক জমা করে রেখেছে বেচবে বলে। তক্ষুনি এসে সে সব ডালপালা নগদ পয়সায় কিনে নিয়ে গেল। এতে বেশ কিছু পয়সা এসে গেল যুবকের হাতে।
সেই পয়সা দিয়ে সে কিছু গুড় আর ছোলা কিনে এক মাঠের ধারে এসে একদিন বসল। কারণ, সেই মাঠে পাঁচশো ঘেসেড়া ঘাস কাটতে আসে প্রতিদিন। ঘাস কেটে আঁটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করে তারা। সেদিন ঘাস কেটে রোদে তেতেপুড়ে ঘেসেড়ারা যখন খুবই ক্লান্ত হয়ে গেল তখন যুবক তাদের কাছে গিয়ে গুড়জল আর ছোলা খেতে দিল। ঘেসেড়েরা বেজায় খুশি হয়ে তাকে এক এক আঁটি করে ঘাস দিতে চাইল। তখন যুবকটি বলল যে, যেদিন তার দরকার হবে সে ঠিক চেয়ে নেবে।
এমনি করে কয়েকদিন কেটে যায়। তারই মধ্যে একদিন যুবক শুনল যে, শহরে এক বণিক নাকি পাঁচশো ঘোড়া নিয়ে সওদা করতে আসছে। খবরটা শুনেই সে গুড় ছোলা নিয়ে মাঠে গেল। সেদিন সে ঘেসেড়াদের বলল, ভাই, আজ তোমরা আমায় এক এক আঁটি করে ঘাস দিও, আর একটা কথা আমি বললে তবেই তোমরা ঘাস বেচো আজ, তার আগে নয়।
ঘেসেড়ারা বলল, বেশ তাই হবে।
তারপরেই গুড় ছোলা খেয়ে সবাই এক এক আঁটি করে ঘাস দিল সেই যুবককে।
যুবকের কথা মতো ঘেসেড়ারা সেদিন ঘাস বেচতে বেরল না। তাই বণিকেরা কোথাও ঘোড়ার জন্য ঘাস পেল না। শেষমেশ অনেক খুঁজে যুবকের কাছে গিয়ে পাঁচশো ঘোড়ার জন্য পেল মাত্র পাঁচশো আঁটি ঘাস। তাই সেগুলো তারা বেশ চড়া দাম দিয়েই যুবকের কাছ থেকে কিনে নিল। ঘাস বেচে যুবকের হাতে এতে এসে গেল একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা।
আর একদিন সে শুনল যে, জাহাজঘাটায় এসেছে এমন একটি জাহাজ, যাতে নাকি রয়েছে অনেক মূল্যবান সব সম্পদ। সেই শুনে অমনি সে জমানো সব টাকাকড়ি নিয়ে হাজির হল এক্কেবারে জাহাজ ঘাটায়। সেখানে পৌঁছেই সটান সেই জাহাজের সমস্ত মাল সে বায়না করে দিল। তারপর বন্দরেই চাকরবাকর নিয়ে শিবির বানিয়ে বড় এক বেনের মতো সাজগোজ করে সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলো।
এদিকে দেশে তো সেই খবর শুনে মহা শোরগোল পড়ে গেল। এমন বেনে কে আছে, যে একাই জাহাজসুদ্ধ মাল কিনে নেয়! তখন তাকে দেখতেই ভিড় করতে লাগল কত কত লোক। তার জন্য ব্যবসা লাটে ওঠার ভয়ে, দেখা করতে এলো শয়ে শয়ে শহরের সব বেনে। তারা জানালো যে, যুবক যদি জাহাজের মাল তাদের মধ্যে ভাগ করে বিক্রি করতে দেয়, তাহলে ব্যবসার কিছু কিছু মুণাফা তারা যুবককে দেবে। যুবক একটু ভাবনাচিন্তার ভান করে শেষমেশ বেনেদের কথায় রাজি হয়ে যায়। এইভাবেই কোথাও কিছু না করে স্রেফ বুদ্ধির জোরে তাদের মুণাফার ভাগ পেয়ে যুবক একেবারে হয়ে গেল দুলাখ টাকার মালিক। এমনি করে সে অল্পদিনেই হয়ে উঠল শহরের সবচেয়ে বড়লোকদের একজন।
তখন সে একদিন দেখা করতে গেল মহান বণিক বোধিসত্ত্বের কাছে। গিয়ে প্রণাম করে সমস্ত বৃত্তান্ত সে জানাল তাঁকে। তার উদ্যম ও বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে বোধিসত্ত্ব এতটাই খুশি হলেন যে ধুমধাম করে নিজের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন।
3. শুক কাহিনী
অতীতকালে পাঞ্চল নগরের রাজা ছিলেন পাঞ্চল। বোধিসত্ত্ব রাজা পাঞ্চলের রাজ্যকালে শুকপাখি হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। একটি নদীর তীরে পাহাড়ের কোলে শিমুলগাছে তিনি বসবাস করতেন, তার সঙ্গে থাকত তার ছোট ভাই।
পাহাড়ের একপাশে বাস করত একদল চোর। আর অন্যপাশে ছিল ঋষিদের গ্রাম। একদিন প্রচন্ড ঝড়ে শিমুলগাছ থেকে ছিটকে বোধিসত্ত্ব পড়লেন ঋষিদের গ্রামে, আর ভাই গিয়ে পড়ল চোরদের গ্রামে।
পাঞ্চলরাজ একদিন শিকারের সন্ধানে গভীর বনে প্রবেশ করেছিলেন। বিকেল গড়িয়ে যখন প্রায় সন্ধে হতে চলল তখন পাঞ্চলরাজের হুশ হল তার সঙ্গিসাথিরা সকলেই হারিয়ে গেছে। সঙ্গীদের খুঁজতে খুঁজতে একসময় ক্লান্ত হয়ে তিনি গাছের নিচে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাজাকে এ অবস্থায় দেখে বোধিসত্ত্বের ভাই এক চোরকে ডেকে রাজার পোশাক গয়নাগাটি সব খুলে নিতে বলল। দুজনের কথা বার্তায় রাজার ঘুম ভেঙে গেল, তাদের কথা বার্তা শুনে রাজা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে পালিয়ে গেলেন। ঋষিদের গ্রাম ধরে তিনি ঘুরতে লাগলেন, শুকপাখিরূপি বোধিসত্ত্ব রাজাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ মহারাজ, এভাবে আপনি ছুটছেন কেনো?’
রাজা থমকে দাড়িয়ে পড়লেন। একভাবে অনেকটা পথ দৌড়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। শুকপাখি বলল, ‘ গ্রামের ঋষিরা সকলে গঙ্গা স্নানে গেছেন, তাই আপনি অথিতি হয়েও আপনার সেবা করবার মতো কেউ নেই। অনুগ্রহ করে নিজেই এই গাছ থেকে ফল পেড়ে আহার করুন এবং শীতল জল পান করুন।’
রাজা পাঞ্চল অবাক হয়ে চোরেদের গ্রামের শুকপাখির কথা বললেন, এবং বললেন তাদের কথোপকথন শুনে তিনি পালিয়ে এসেছেন।
শুক পাখিরূপি বোধিসত্ত্ব তখন বললেন, ‘মহারাজ, ওই শুকপাখিটি আমার ছোট ভাই। দুর্ভাগ্যক্রমে একদিনের ঝড়ে সে গিয়ে পড়েছিল চোরেদের গ্রামে। ফলে ওকে মিথ্যা আর চুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে, আর আমি এসে পড়লাম ঋষিদের গ্রামে। তাই তার ধর্ম সে করছে, আমার ধর্মের পালন আমি করছি।’
আর পড়ুন: চু কোই ও বট গাছের গল্প – ভিয়েতনামের একটি সুন্দর রূপকথা
4. পথ কুকুর
জাতকের প্রতিটি কাহিনীতেই পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্মের কথা বলা হয়েছে। সেই সারমেয় বা কুকুরের গল্পটা ধরা যাক। এই গল্পটাও জাতকের আর পাঁচটা গল্পের মতোই নীতিকাহিনী।
কুকুরটি ছিল গৃহহীন। পথেঘাটেই ছিল তার বাস। জাতকের এই কাহিনী থেকে জানা যায়, একবার বুদ্ধদেবের এরকম জন্ম হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল কুকুরটির। এই চরিত্রগুণেই সে একদিন রাস্তার সব কুকুরদের নেতা হয়ে যায়। কোনো একটি ঘটনার জন্য রাজার বিষনজর পড়েছিল রাস্তার কুকুরগুলোর ওপর। আর তাদের বাঁচানোর দায়িত্ব কুকুরদের দলনেতা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
রাজার রথের জন্য যে ঘোড়ার সাজ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছিল। রাতভর বৃষ্টিতে সাজ একেবারে ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সাজের চামড়ার অংশটুকু হয়ে গিয়েছিল নরম আর সুসিদ্ধ। এক ঝাঁক শিকারি কুকুর ছিল রাজার। চামড়ার সাজ টুকরো-টুকরো করে সেই শিকারি কুকুরের দল ভোজনপর্ব সেরেছিল।
খবর গেল রাজার কাছে। কিন্তু প্রাসাদের ভৃত্যরা জানালো, রাস্তার কুকুরগুলো পয়ঃপ্রণালী দিয়ে প্রাঙ্গণে ঢুকে চামড়ার সাজ খেয়েছে। রাজা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, আদেশ দিলেন, শহরের সমস্ত কুকুরকে নিধন করতে হবে। ভীতসন্ত্রস্ত ক্ষুদ্ধ কুকুরের দল ছুটে এলো সেই গৃহহীন কুকুরের কাছে। সেই কুকুর তার বিক্ষুব্ধ অনুগামীদের শান্ত করলো এবং প্রাসাদের পথে রওনা হলো।
সবসময় সত্যের ওপর ভরসা রাখার সহজ পথটি অনুসরণ করতো কুকুরটি। আর সেই সত্যের জোরেই সে পৌঁছে গেল রাজার কাছে। পথে কোনো নিপীড়নের শিকার হতে হলো না তাকে। রাজাকে বুঝিয়ে বললো সে। কুকুরটি রাজাকে তার নিজের শিকারি কুকুরদের ঘাস আর ঘোল খাওয়ানোর পরামর্শ দিল। রাজা সেইমতো আদেশ দিলেন। রাজার শিকারি কুকুরদের ঘাস আর ঘোল খাওয়ানোর সাথে-সাথে বমি করলো কুকুরের দল। বেরিয়ে এলো চামড়ার সব টুকরো।
কুকুরটি প্রমাণ করলো, তার অনুগামীরা একেবারেই নির্দোষ। ভবঘুরে কুকুরটির জ্ঞানবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে রাজা তারই খাবার থেকে কুকুরটিকে নিয়মিত ভাগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কোনো প্রাণীকেই কখনও হত্যা করা হবে না, কুকুরটির এই অনুরোধ রাজা মঞ্জুর করলেন। এই কাহিনীর প্রধান চরিত্রটি যে স্বয়ং বুদ্ধদেব, তা আগেই বলা হয়েছে। আর রাজা হলেন তারই প্রধান শিষ্য আনন্দ।
5. অতি যত্নের ফল
অতীতকালে বোধিসত্ত্ব এক গৃহস্থের বাড়িতে গোরু হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার নাম হয় মহালোহিত। তার একটি ছোট ভাই ছিল। তার নাম চুল্লোলোহিত।
কিছুদিন পর ওই গৃহস্থ তার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। একটি ভালো পাত্রও পাওয়া গেলো।
শালুক নামে গেরস্তের বাড়িতে একটি শুয়োর থাকত। বিয়ের দিন পাকা হওয়ার পর গৃহস্থ শুয়োরটাকে খুব যত্ন করে খাওয়াতে লাগলেন। তার ইচ্ছা, বিয়ের দিন এই শুয়োরটাকে মেরে বরযাত্রীদের মাংস খাওয়াবেন।
চুল্লোলোহিত শুয়োরের খাবারের ঘটা দেখে তার দাদাকে বলল, ‘ দাদা, আমরা গৃহস্থের কত কাজ করি। অথচ আমাদের ঠিকমতো খেতে দেয় না। এমনকি কোনও আদরযত্নও করে না। শুয়োরকে কত আদরযত্ন করে, ভাল ভাল খাবার খেতে দেয়।’
মহালোহীতরুপি বোধিসত্ত্ব বললেন, ‘ ভাই, তুমি আর জানবে কি করে যে, গৃহস্থ কেন এই শুয়োরকে এত আদরযত্ন করছে। ওর আয়ু আর বেশিদিন নেই। মেয়ের বিয়ের দিন ওকে জবাই করা হবে। তাই শুয়োরটাকে খাইয়েদাইয়ে মোটা করা হচ্ছে।
কয়েকদিন পর বিয়ের দিন এসে গেল। শুয়োরটাকে সেদিন সত্যি সত্যি জবাই করা হল।
চুল্লোলোহীত সব দেখেশুনে তার দাদাকে বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ দাদা। আমাদের আদরযত্ন দরকার নেই। আমরা যেমন আছি এই আমাদের ভালো।’