Customize Consent Preferences

We use cookies to help you navigate efficiently and perform certain functions. You will find detailed information about all cookies under each consent category below.

The cookies that are categorized as "Necessary" are stored on your browser as they are essential for enabling the basic functionalities of the site. ... 

Always Active

Necessary cookies are required to enable the basic features of this site, such as providing secure log-in or adjusting your consent preferences. These cookies do not store any personally identifiable data.

No cookies to display.

Functional cookies help perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collecting feedback, and other third-party features.

No cookies to display.

Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics such as the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.

No cookies to display.

Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.

No cookies to display.

Advertisement cookies are used to provide visitors with customized advertisements based on the pages you visited previously and to analyze the effectiveness of the ad campaigns.

No cookies to display.

কলাবতী-রাজকণ্যা

ঠাকুরমার ঝুলি
 

এক যে রাজা। রাজার সাত রাণী।- বড়রাণী, মেজরাণী, সেজরাণী, ন-রাণী, কনেরাণী, দুয়োরাণী আর ছোটরাণী।

রাজার মস্ত-বড় রাজ্য। প্রকান্ড রাজবাড়ী। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, ভান্ডারে মাণিক, কুঠরীভরা মোহর, রাজার সব ছিল। এছাড়া, -মন্ত্রী, আমত্য, সিপাই, লস্করে, – রাজপুরী গমগম করিত।

কিন্তু, রাজার মনে সুখ ছিল না। সাত রাণী, এক রাণীরও সন্তান হইল না। রাজা, রাজ্যের সকলে, মনের দুঃখে দিন কাটেন।

একদিন রাণীরা নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছেন, -এমন সময়, এক সন্ন্যাসী যে, বড়রাণীর হাতে একটি গাছের শিকড় দিয়া বলিলেন,-“এইটি বাটিয়া সাত রাণী খাইও, সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।”

রাণীরা, মনের আনন্দে তাড়াতাড়ি স্নান করিয়া আসিয়া, কাপড়-চোপড় ছাড়িয়া, গা-মাথা শুকাইয়া, সকলে পাকশালে গেলেন। আজ বড়রাণী ভাত রাধিবেন, মেজরাণী তরকারী কাটিবেন, সেজরাণী ব্যঞ্জন রাঁধিবেন, ন-রাণী জল তুলিবেন, কনেরাণী যোগন দিবেন, দুয়োরাণী বাটনা বাটিবেন আর ছোটরাণী মাছ কুটিবেন। পাঁচরাণী পাকশালে রহিলেন; ন-রাণী কূয়োর পাড়ে গেলেন, ছোটরাণী পাঁশগাদার পাশে মাছে কুটিতে বসিলেন।

সন্ন্যাসীর শিকর বড়রাণীর কাছে। বড়রাণী দুয়োরাণীকে ডাকিয়া বলিলেন, – “বোন, তুই বাটনা বাটিবি, শিকড়টি আগে বাটিয়া দে না সকলে একটু একটু খাই।”

দুয়োরাণী শিকড় বাটিতে বাটিতে একটুকু নিজে খাইয়া ফেলিলেন। তাহার পর, রূপার খালে সোনার বাটি দিয়া ঢাকিয়া, বড়রাণীর কছে দিলেন। বড়রাণী ঢাকনা খুলিতেই আর কতকটা খাইয়া সেজরাণীকে দিলেন। সেজরাণী কিছু খাইয়া, কনেরাণীকে দিলেন। করেরাণী বাকীটুকু খাইয়া ফেলিলেন। ন-রাণী আসিয়া দেখেন, বাটিতে তলানী পড়িয়া আছে। তিনি তা্হাই খাইলেন। ছোটরাণীর জন্য আর কিছুই রহিল না।

মাছ কোটা হইলে, ছোটরাণী উঠিলেন। পথে ন-রাণীর সঙ্গে দেখা হইল। ন-রাণী বলিলেন,-ও অভাগি! তুই তো শিকড়বাটা খাইলি না?- যা যা, শীগগির যা।” ছো্ট রাণী আকুলি ব্যাকুলি করিয়া ছটিয়া আসিলেন; আসিয়া দেখিলেন, শিকড়বাটা একটুকুও নাই। দেখিয়া ছোটরাণী, আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়িলেন।

তখন পাঁচরাণী এ-র দোষ ও দেয়। ও-র দোষ এ দেয়। এই রকম করিয়া সকলে মিলিয়া গোলমাল করিতে লাগিলেন। ছোটরাণীর হাতের মাছ আঙ্গিনায় গড়াগড়ি গেল, চোখের জলে আঙ্গিনা ভাসিল।

একটু পরে ন-রাণী আসিলেন। তিনি বলিলেন- “ওমা! ওর জন্য কি তোরা কিছুই রাখিস নাই? কেমন লো তোরা! চল বোন ছোটরাণী, শিল-নোড়াতে যদি একাধটুকু লাগিয়া থাকে, তাই তোকে ধুইয়া খাওয়াই। ঈশ্বর করেনতো, উহাতেই তোর সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।”

অন্য রাণীরা বলিলেন,-“তা’ই তো, তা’ই তো, শিল নোড়াতে আছে, তাই ধুইয়া দেও।” মনে মনে বলিলেন, -“শিল ধোয়া জল খাইলে-সোনার চাঁদ না তো বানর চাঁদ ছেলে হইবে।”

ছোটরাণী কাঁদিয়া-কাটিয়া শিল-ধোয়া জলটুকুই খাইলেন। তারপর, ন-রাণীতে ছোটরাণীতে ভাগাভাগি করিয়া জল আনিতে গেলেন। আর রাণীরা নানা কথা বলাবলি করিতে লাগিলেন।

(২)

দশ মাস দশ দিন যায়, পাঁচ রাণীর পাঁচ ছেলে হইল। এক-এক ছেলে যেন সোনার চাঁদ! ন-রাণী আর ছোটরাণীর কি হইল? বড়রাণীর কথাই সত্য; ন-রাণীর এক পেঁচা আর ছোটরাণীর পেটে এক বানর হইল।

বড় রাণীদের ঘরের সামনে ঢোল-ডাগর বাজিয়া উঠিল। ন-রাণী আর ছোটরাণীর ঘরে কান্নকাটি পড়িয়া গেল।

রাজা আর রাজ্যের সকলে আসিয়া, পাঁচ রাণীকে জয়ডঙ্কা দিয়া ঘরে তুললেন। ন-রাণী, ছোটরাণীকে কেহ জিজ্ঞাসাও করিল না।

কিছুদিনপর ন-রাণী চিড়িয়াখানার বাদী আর ছোটরাণী ঘুঁটেকুড়াণী দাসী হইয়া দুঃখে কষ্টে দিন কাটাইতে লাগিল।

(৩)

ক্রমে ক্রমে রাজার ছেলেরা বড় হইয়া উঠিল; পেঁচা আর বানরও বড় হইল। পাঁচ রাজপুত্রের নাম হইল- হীরারাজপুত্র, মাণিকরাজপুত্র, মোতিরাজপুত্র, শঙ্খরাজপুত্র আর কাঞ্চনরাজপুত্র। পেঁচার নাম হইল ভূতুম আর বানরের নাম হইল বুদ্ধু।

পাঁচ রাজপুত্র পাঁচটি পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ায়। তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে কত সিপাই লস্কর পাহারা থাকে।ভূতুম আর বুদ্ধু দুইজনে তাহাদের মায়েদের কুঁড়েঘরের পাশে একটা ছোট বকুল গাছের ডালে বসিয়া খেলা করে।

পাঁচ রাজপুত্রেরা বেড়াইতে বাহির হইয়া আজ ইহাকে মারে, কাল উহাকে মারে, আজ ইহার গর্দান নেয়, কাল উহার গর্দান নেয়; রাজ্যের লোক তিতি-বিরক্ত হইয়া উঠিল।

ভূতুম আর বুদ্ধু, দুইজনে খেলাধুলা করিয়া, যা’র- যা’র মায়ের সঙ্গে যায়। বুদ্ধু মায়ের গুঁটে কুড়াইয়া দেয়, ভূতুম চিড়িয়াখানার পাখীর ছানাগুলিকে আহার খাওয়াইয়া দেয়। আর দুই- একদিন পরুপর দুইজনে রাজবাড়ীর দক্ষিণ দিকে বনের মধ্যে বেড়াইতে।

ভূতুমের মা চিড়িয়াখানার বাঁদী, বুদ্ধুর মা গুঁটে- কুড়ানী দাসী। কোনদিন খাইতে পায়, কোনদিন পায় না। বুদ্ধু দুই মায়ের জন্য বণ জঙ্গল হইতে কত রকমের ফল আনে। ভূতুম ঠোঁটে করিয়া দুই মায়ের পান খাইবার সুপারী আনে। এই রকম করিয়া ভূতুম, ভূতুমের মা’র দিন যায়।

একদিন পাঁচ রাজপুত্র পক্ষিরাজ ঘোড়া ছুটাইয়া চিড়িয়াখানা দেখিতে আসিলেন। আসিতে, পথে দেখিলেন, একটি পেঁচা আর একটি বানর বকুল গাছে বসিয়া আছে। দেখিয়াই তাঁহারা সিপাই লস্করকে হুকুম দিলেন- “ঐ পেঁচা আর বানরকে ধর, আমরা উহাদিগে পুষিব।” অমনি সিপাই-লস্করেরা বকুল গাছে জাল ফেলিল। ভূতুম আর বুদ্ধু জাল ছিঁড়িতে পারিল না। তাহারা ধরা পড়িয়া, খাঁচায় বদ্ধ হইয়া রাজপুত্রদের সঙ্গে রাজপুরীতে আসিল।

চিড়িয়া খানা পরিষ্কার করিয়া ভূতুমের মা আসিয়া দেখেন, ভূতুম নাই! ঘেুঁটে ছড়াইয়া বুদ্ধুর মা আসিয়া দেখেন, বুদ্ধু নাই! ভূতুমের মা হাতের ঝাঁটা মাটিতে ফেলিয়া বসিয়া পড়িলেন, বুদ্ধুর মা গোবরের ঝাঁটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া আছাড় খাইয়া পড়িলেন।

(৪)

রাজপুরীতে আসিয়া ভূতুম আর বুদ্ধু অবাক!- মস্ত-মস্ত দালান; হাতী, ঘোড়া, সিপাই লস্কর কত কি!
দেখিয়া তাহারা ভাবিল-“বা! তবে আমরা বকুল গাছে থাকি কেন?” ভাবিয়া তাহারা বলিল, – “ও ভাই রাজপুত্র, আমাদিগে আনিয়াছ তো, মাদিগেও আন।”
রাজপুত্ররা দেখিলেন, বাঃ! ইহারা তো মানুষের মতো কথা কয়! তখন বলিলেন- “বেশ বেশ তোদের মায়েরা কোথায় বল; আনিয়া চিড়িয়াখানায় রাখিব।”
ভূতুম বলিল, “চিড়িয়াখানার বাঁদী আমার মা।”
বুদ্ধু বলিল,- “ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী আমার মা!”
শুনিয়া রাজপুতেরা হাসিয়া উঠিলেন- “মানুষের পেটে আবার পেঁচা হয়! মানুষের পেটে আবার বানর হয়!”
ছোটরাণী আর ন-রাণীর কথা, রাজপুত্রেরা কি- না জানিতেন না, একজন সেপাই ছিল, সে বলিল, – “হইবে না কেন? আমাদের দুই রাণী ছিলেন, তাঁহাদের পেটে পেঁচা আর বানর হইয়াছিল। রাজা সেইজন্য তাঁহাদিগে দূর করিয়া দেন। ইহারাই সেই পেঁচা আর বানর পুত্র।

শুনিয়া রাজপুত্রেরা “ছি ছি!” করিয়া উঠিলেন। তখনই খাঁচার উপর লাথি মারিয়া, রাজপুত্রেরা সিপাই-লস্করকে বলিলেন- “ এই দুইটাকে দূর করিয়া দাও।” বলিয়া রাজ্যের ছেলেরা পক্ষিরাজে চড়িয়া বেড়াইতে চলিয়া গেলেন।
ভূতুম আর বুদ্ধু জানিল, তাহারাও রাজার ছেলে! ভূতুমের মা বাঁদী নয়, বুদ্ধুর মা দাসী নয়। তখন বুদ্ধু বলিল, – “দাদা, চল আমরা বাবার কাছে যাইব।”
ভূতুম বলিল, – “চল”।

(৫)

সোনার খাটে গা, রূপার খাটে পা রাখিয়া রাজপুরীর মধ্যে. পাঁচ রাণীতে বসিয়া সিঁথিপাটি করিতেছিলেন। এক দাসী আসিয়া খবর দিল, নদীর ঘাটে যে, শুকপঙ্খী নৌকা আসিয়াছে, তাহার রূপার বৈঠা, হীরার হাল। নায়ের মধ্যে মেঘ-বরণ চুল কুঁচ-বরণ কন্যা বসিয়া সোনার শুকের সঙ্গে কথা কহিতেছে।
অমনি নদীর ঘাটে পাহারা বসিল; রাণীরা উঠেন-কি-পড়েন, কে আগে কে পাছে; শুকপঙ্খী নায়ে কুঁচ-বরণ কন্যা দেখিতে চলিলেন।
তখন শুকপঙ্খী নায়ে পাল উড়িয়াছে; শুকপঙ্খী তরতর করিয়া ছুটিয়াছে।
রাণীরা বলিলেন–

“কুঁচ-বরণ কন্যা মেঘ বরণ চুল।
নিয়া যাও কন্যা মোতির ফুল।”
নৌকা হইতে কুঁচ-বরণ কন্যা বলিলেন,–

“মোতির ফুল মোতির ফুল সে বড় দূর,
তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর পুর।
হাটের সওদা ঢোল-ডাগরে. গাছের পাতে ফল।
তিন বুড়ির রাজ্য ছেড়ে রাঙ্গা নদীর জল।”
বলিতে বলিতে, শুকপক্ষী নৌকা অনেক দূরে চলিয়া গেল। রাণীরা সকলে বলিলেন–

“কোন দেশের রাজকন্যা কোন দেশে ঘর?
সোনার চাঁদ ছেলে আমার তো-মার বর।”
তখন শুকপক্ষী আরও অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে; কুঁচবরণ কণ্যা উত্তর করিলেন,–

“কলাবতীর রাজকণ্যা্ মেঘ বরণ কেশ,
তোমার পুত্র পাঠাইও কলাবতীর দেশ।
আনতে পারে মোতির ফুল ঢোল-ডাগর,
সেই পুত্রের বাঁদী হয়ে আসব তোমার ঘর।”
শুকপক্ষী আর দেখা গেল না। রাণীরা অমনি ছেলেদের কাছে খকবর পাঠাইলেন। ছেলেরা পক্ষিরাজে ছুটাইয়া বাড়িতে আসিল। রাজা সকল কথা শুনিয়া ময়ূরপঙ্খী সাজাইতে হুকুম দিলেন। হুকুম দিয়া, রাজা, রাজসভায় দরবার করিতে গেলেন।

(৬)

মস্ত দরবার করিয়া রাজা রাজসভায় বসিয়াছেন। ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু গিয়া সেইখানে উপস্থিত হইল। দুয়ারী জিজ্ঞাসা করিল,— ‘তোমরা কে?’

বুদ্ধু বলিল,— ‘বানররাজপুত্র।’
ভূতুম্‌ বলিল,— ‘পেঁচারাজপুত্র।’
দুয়ারী দুয়ার ছাড়িয়া দিল। তখন বুদ্ধু এক লাফে গিয়া রাজার কোলে বসিল। ভূতুম উড়িয়া গিয়া রাজার কাঁধে বসিল। রাজা চমকিয়া উঠিলেন; রাজসভায় সকলে হাঁ! হাঁ!!— করিয়া উঠিল।

বুদ্ধু ডাকিল,— ‘বাবা!’
ভূতুম্‌ ডাকিল,— ‘বাবা!’
রাজসভার সকলে চুপ। রাজার চোখ দিয়া টস্‌—টস্‌ করিয়া জল গড়াইয়া গেল। রাজা ভূতুমের গালে চুমা খাইলেন, বুদ্ধুকে দুই হাত দিয়া বুকে তুলিয়া লইলেন। তখনি রাজসভা ভাঙ্গিয়া দিয়া বুদ্ধু আর ভূতুমকে লইয়া রাজা উঠিলেন।

(৭)

এদিকে তো সাজ সাজ পড়িয়া গিয়াছে। পাঁচ নিশান উড়াইয়া পাঁচখানা ময়ূরপঙ্খী আসিয়া, ঘাটে লাগিল। রাজপুত্রেরা তাহাতে উঠিলেন। রাণীরা হুলুধ্বনি দিয় পাঁচ রাজপুত্রকে কলাবতী রাজকন্যার দেশে পাঠাইলেন। সেই সময়ে ভূতুম্‌ আর বুদ্ধুকে লইয়া, রাজা যে, নদীর ঘাটে আসিলেন।
বুদ্ধু বলিল,— ‘বাবা, ও কি যায়?’
রাজা বলিলেন,— ‘ময়ূরপঙ্খী।’
বুদ্ধু বলিল,— ‘বাবা, আমরা ময়ূরপঙ্খীতে যাইব; আমাদিকে ময়ূরপঙ্খী দাও।’
ভূতুম্‌ বলিল.— ‘বাবা, ময়ূরপঙ্খী দাও।’
রাণীরা সকলে কিল্‌ কিল্‌ করিয়া উঠিলেন—

‘কে লো, কে লো, বাঁদীর ছানা নাকি লো?’
‘কে লো, কে লো, ঘুঁটে—কুড়ানীর ছা নাকি লো?’
‘ও মা, ও মা, ছি! ছি!’
রাণীরা ভূতুমের এবং বুদ্ধুর গালে চড় মারিয়া ফেলিয়া দিলেন। রাজা আর কথা কহিতে পারিলেন না; চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। রাণীরা রাগে গর্‌—গর্‌ করিতে—করিতে রাজাকে লইয়া রাজপুরীতে চলিয়া গেলেন।
বুদ্ধু বলিল,— ‘দাদা?’
ভূতুম্‌ বলিল,—’ভাই?’
বুদ্ধু। ‘চল আমরা ছুতোরবাড়ী যাই, ময়ূরপঙ্খী গড়াইব; রাজপুত্রেরা যেখানে গেল, সেইখানে যাইব।’
ভূতুম্‌ বলিল,—’চল।’

(৮)

দিন নাই, রাত্রি নাই, কাঁদিয়া কাটিয়া ভূতুমের মা, বুদ্ধুর মায়ের দিন যায়। তাঁহারাও শুনিলেন, রাজপুত্রেরা ময়ূরপঙ্খী করিয়া কলাবতী রাজকন্যার দেশে চলিয়াছেন। শুনিয়া, দুইজনে, দুইজনের গলা ধরিয়া আরও কাঁদিতে লাগিলেন। কাঁদিয়া—কাটিয়া দুই বোনে শেষে নদীর ধারে আসিলেন। তাহার পরে, দুইজনে দুইখানা সুপারীর ডোঙ্গায়, দুইকড়া কড়ি, ধান দূর্বা আর আগা—গলুইয়ে পাছা—গলুইয়ে সিন্দুরের ফোঁটা দিয়ে ভাসাইয়া দিলেন।
বুদ্ধুর মা বলিলেন,—

‘বুদ্ধু আমার বাপ!
কি করেছি পাপ?
কোন পাপে ছেড়ে গেলি, দিয়ে মনস্তাপ?
শুকপঙ্খী নায়ের পাছে ময়ূরপঙ্খী যায়,
আমার বাছা থাক্‌লে যেতিস্‌ মায়ের এই নায়।
পৃথিবীর যেখানে যে আছ ভগবান,—
আমার বাছার তরে দিলাম এই দূর্বা ধান।’
ভূতুমের মা বলিলেন—

‘ভূতুম আমার বাপ!
কি করেছি পাপ?
কোন্‌ পাপে ছেড়ে গেলি, দিয়ে মনস্তাপ?
শুকপক্ষী নায়ের পাছে ময়ূরপঙ্খী যায়,
আমার বাছা থাকলে যেতিস মায়ের এই নায়।
পৃথিবীর যেখানে যে আছ ভগবান্‌,—
আমার বাছার তরে দিলাম এই দূর্বা ধান।’
সুপারির ডোঙ্গা ভাসাইয়া দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ভূতুমের মা, বুদ্ধুর মা কুঁড়েতে ফিরিলেন।

(৯)

ছুতোরের বাড়ী যাইতে—যাইতে পথে ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু দেখিল, দুইখানি সুপারীর ডোঙ্গা ভাসিয়া যাইতেছে।
বুদ্ধু বলিল, ‘দাদা, এই তো আমাদের না;— এই নায়ে উঠ।’
ভূতুম্‌ বলিল,— ‘উঠ।’
তখন, বুদ্ধু আর ভূতুম্‌ দুইজনে দুই নায়ে উঠিয়া বসিল। দুই ভাইয়ের দুই ময়ূরপঙ্খী যে পাশাপাশি ভাসিয়া চলিল।
লোকজনে দেখিয়া বলে,— ‘ও মা! এ আবার কি?’
বুদ্ধু বলে, ভূতুম্‌ বলে,— ‘আমরা বুদ্ধু আর ভূতুম্‌।’
বুদ্ধু ভূতুম্‌ যায়।

(১০)

আর, রাজপুত্রেরা? রাজপুত্রদের ময়ূরপঙ্খী যাইতে যাইতে তিন বুড়ীর রাজ্যে গিয়া পৌঁছিল। অমনি তিন বুড়ীর তিন বুড়া পাইক আসিয়া নৌকা আটকাইল। নৌকা আটকাইয়া তাহারা মাঝি-মাল্লা সিপাই-লস্কর সব শুদ্ধ পাঁচ রাজপুত্রকে থলে’র মধ্যে পুরিয়া তিন বুড়ীর কাছে নিয়া গেল। তাহাদিগে দিয়া তিন বুড়ী তিন সন্ধ্যা জল খাইয়া, নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল!
অনেক রাত্রে, তিন বুড়ীর পেটের মধ্য হইতে রাজপুত্রেরা বলাবলি করিতে লাগিল,— ‘ভাই, জন্মের মতো বুড়ীদের পেটে রহিলাম। আর মা’দিগে দেখিব না, আর বাবাকে দেখিব না।’
এমন সময় কাহারা আসিয়া আস্তে আস্তে ডাকিল,— ‘দাদা! দাদা!’
রাজপুত্রেরা চুপি-চুপি উত্তর করিল,— ‘কে ভাই, কে ভাই? আমরা যে বুড়ীর পেটে!’
বাহির হইতে উত্তর হইল, ‘আমার লেজ ধর’; ‘আমার পুচ্ছ ধর।’
রাজপুত্রেরা লেজ ধরিয়া, পুচ্ছ ধরিয়া, বুড়ীদের নাকের ছিদ্র দিয়া বাহির হইয়া আসিল। আসিয়া দেখে; বুদ্ধু আর ভূতুম্‌!
বুদ্ধু বলিল,— ‘চুপ, চুপ! শীগ্‌গীর তরোয়াল দিয়ে বুড়ীদের গলা কাটিয়া ফেল।’
রাজপুত্রেরা তাহাই করিলেন। রাজপুত্র, মাল্লা-মাঝি সকলে বাহির হইয়া আসিল। আসিয়া, সকলে তাড়াতাড়ি গিয়া ময়ূরপঙ্খীতে পাল তুলিয়া দিল। বুদ্ধু আর ভূতুম্‌কে কেহ জিজ্ঞাসাও করিল না।

(১১)

ময়ূরপঙ্খী সারারাত ছুটিয়া ছুটিয়া ভোরে রাঙ্গা নদীর জলে গিয়া পড়িল। রাঙ্গা নদীর চারিদিকে কূল নাই, কিনারা নাই, কেবল রাঙ্গা জল। মাঝিরা দিক হারাইল; পাঁচ ময়ূরপঙ্খী ঘুরিতে ঘুরিতে সমুদ্রে গিয়া পড়িল। রাজপুত্র মাল্ল-মাঝি সকলে হাহাকার করিয়া উঠিল। সাত দিল সাত রাত্রি ধরিয়া ময়ূরপঙ্খীগুলি সমুদ্রের মধ্যে আছাড়িপিছাড়ি করিল। শেষে, নৌকা আর থাকে না; সব যায়-যায়! রাজপুত্রেরা বলিলেন— ‘হায় ভাই, বুদ্ধু ভাই থাকিতে আজি এখন রক্ষা করিত!’ ‘হায় ভাই, ভূতুম্‌ ভাই থাকিতে এখন রক্ষা করিত!’

‘কি ভাই, কি ভাই!
কি চাই, কি চাই?’
বলিয়া বুদ্ধু আর ভূতুম্‌ তাহাদের সুপারীর ডোঙ্গা ময়ূরপঙ্খীর গলুইয়ের সঙ্গে বাঁধিয়া থুইয়া, রাজপুত্রদের কাছে আসিল। আর, মাঝিদিগে বলিল, ‘উত্তর দিকে পাল তুলিয়া দে।’
দেখিতে দেখিতে ময়ূরপঙ্খী সমুদ্র ছাড়াইয়া এক নদীতে আসিয়া পড়িল। নদীর জল যেন টল্‌টল্‌ ছল্‌ছল্‌ করিতেছে। দুই পাড়ে আম-কাঁঠালের হাজার গাছ। রাজপুত্রেরা সকলে পেট ভরিয়া আম, কাঁঠাল খাইয়া, সুস্থির হইলেন। তখন রাজপুত্রেরা বলিলেন, ‘ময়ূরপঙ্খীতে বানর আর পেঁচা কেন রে? এ দুইটাকে জলে ফেলিয়া দে।’ মাঝিরা বুদ্ধু আর ভূতুম্‌কে জলে ফেলিয়া দিল; তাহাদের সুপারীর ডোঙ্গা খুলিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিল। নদীর জলে ময়ূরপঙ্খী আবার চলিতে লাগিল।
চলিতে চলিতে এক জায়গায় আসিয়া পাঁচটি ময়ূরপঙ্খীই রাজপুত্র, মাল্লা, মাঝি সব লইয়া, ভুস করিয়া ডুবিয়া গেল। আর তাহাদের কোনও চিহ্ন—ই রহিল না।
কতক্ষণ পর, বুদ্ধু আর ভূতুমের ডোঙ্গা যে, সেইখানে আসিল। বুদ্ধু বলিল,—’দাদা!’
ভূতুম্‌ বলিল, ‘কি?’
বুদ্ধু!— ‘আমার মন যেন কেমন—কেমন করে, এইখানে কি হইয়াছে। এস তো, ডুব দিয়া, দেখি।’
ভূতুম্‌ বলিল, ‘হ’ক গে! ওরা মরিয়া গেলেই বাঁচি। আমি ডুব্‌টুব দিতে পারিব না।’
বুদ্ধু বলিল,— ‘ছি, ছি, অমন কথা বলিও না। তা, তুমি থাক; এই আমার কোমরে সূতা বাঁধিলাম, যতদিন সূতাতে টান না দিব, ততদিন যেন তুলিও না’
ভূতুম্‌ বলিল,— ‘আচ্ছা, তা— পারি।’
তখন বুদ্ধু নদীর জলে ডুব দিল; ভূতুম্‌ সূতা ধরিয়া বসিয়া রহিল।

(১২)

যাইতে যাইতে বুদ্ধু পাতাল—পুরীতে গিয়া দেখিল, এক মস্ত সুড়ঙ্গ। বুদ্ধু সুড়ঙ্গ দিয়া, নামিল।
সুড়ঙ্গ পার হইয়া বুদ্ধু দেখিল, এক যে— রাজপুরী!—যেন ইন্দ্রপুরীর মত!!
কিন্তু সে রাজ্যে মানুষ নাই, জন নাই, কেবল এক একশ বচ্ছুরে বুড়ী বসিয়া একটি ছোট কাঁথা সেলাই করিতেছে। বুড়ী বুদ্ধুকে দেখিয়াই হাতের কাঁথা বুদ্ধুর গায়ে ছুঁড়িয়া মারিল। অমনি হাজার হাজার সিপাই আসিয়া বুদ্ধুকে বাঁধিয়া—ছাঁদিয়া রাজপুরীর মধ্যে লইয়া গেল।
নিয়া গিয়া, সিপাইরা, এক অন্ধকুঠরীর মধ্যে, বুদ্ধুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিল। অমনি কুঠরীর মধ্যে— ‘বুদ্ধু ভাই, বুদ্ধু ভাই, আয় ভাই, আয় ভাই।’ বলিয়া অনেক লোক বুদ্ধুকে ঘিরিয়া ধরিল। বুদ্ধু দেখিল, রাজপুত্র আর মাল্লা—মাঝিরা!
বুদ্ধু বলিল,— ‘বটে! তা, আচ্ছা!’
পরদিন বুদ্ধু দাঁত মুখ সিট্‌কাইয়া মারিয়া রহিল! এক দাসী রাজপুত্রদিগে নিত্য কি—না খাবার দিয়া যাইত! সে আসিয়া দেখে, কুঠরীর মধ্যে একটা বানর মরিয়া পড়িয়া আছে। সে যাইবার সময় মরা বানরটাকে ফেলিয়া দিয়া গেল। আর কি?— তখন বুদ্ধু আস্তে আস্তে চোখ মিটি—মিটি উঠে। না তো, এদিক ওদিক চাহিয়া বুদ্ধু, উঠিল। উঠয়াই বুদ্ধু দেখিল প্রকাণ্ড রাজপুরীর তে-তলায় মেঘবরণ চুল কুঁচবরণ কন্যা সোনার শুকের সঙ্গে কথা কহিতেছে।
বুদ্ধু গাছের ডালে—ডালে, দালানের ছাদে—ছাদে গিয়া কুঁচবরণ কন্যার পিছনে দাঁড়াইল। তখন কুঁচ—বরণ কন্যা বলিতেছিলেন,—

‘সোনার পাখী, ও রে শুক, মিছাই গেল
রূপার বৈঠা হীরার হা’ল কেউ না এল’!
রাজকন্যার খোঁপায় মোতির ফুল ছিল, বুদ্ধু আস্তে— মোতির ফুলটি উঠাইয়া লইল।

তখন শুক বলিল,
‘কুঁচ—বরণ কন্যা মেঘবরণ চুল,
কি হইল কন্যা, মোতির ফুল?’
রাজকন্যা খোঁপায় হাত দিয়া দেখিলেন, ফুল নাই। শুক বলিল,—

কলাবতী রাজকন্যা, চি’ন্ত না’ক আর,
মাথা তুলে’ চেয়ে দেখ, বর তোমার!’
কলাবতী, চমকিয়া পিছন ফিরিয়া দেখেন,— বানর! কলাবতীর মাথা হেঁট হইল। হাতের কাঁকণ ছুঁড়িয়া ফেলিয়া, মেঘ—বরণ চুলের বেণী এলাইয়া দিয়া, কলাবতী রাজকন্যা মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন।
কিন্তু, রাজকন্যা কি করিবেন? যখন পণ করিয়াছিলেন, যে, তিন বুড়ীর রাজ্য পার হইয়া, রাঙ্গা-নদীর জল পাড়ি দিয়া, কাঁথা—বুড়ীর, আর, অন্ধকুঠরীর হাত এড়াইয়া তাঁহার পুরীতে আসিয়া যে মোতির ফুল নিতে পারিবে, সে-ই তাঁহার স্বামী হইবে। তখন রাজকন্যা আর কি করেন?—উঠিয়া বানরের গলায় মালা দিলেন। তখন বুন্ধু হাসিয়া বলিল, ‘রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?’
রাজকন্যা বলিলেন,— ‘আগে ছিলাম বাপের—মায়ের, তা’র পরে ছিলাম আমার; এখন তোমার।—
বুদ্ধু বলিল,— ‘তবে আমার দাদাদিগে ছাড়িয়া দাও, আর তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়ীতে চল। মা’দের বড় কষ্ট, তুমি গেলে তাঁহাদের কষ্ট থাকিবে না।’
রাজকন্যা বলিলেন,— ‘এখন তুমি যাহা বলিবে, তাহাই করিব। তা চল;— কিন্তু তুমি আমাকে এমনি নিতে পারিবে না, —আমি এই কৌটার মধ্যে থাকি, তুমি কৌটায় করিয়া আমাকে লইয়া চল।’
বুদ্ধু বলিল,— ‘আচ্ছা।’
রাজকন্যা কৌটার ভিতর উঠিলেন।
অমনি শুকপাখী তাড়াতাড়ি গিয়া ঢোল-ডগরে ঘা দিল। দেখিতে দেখিতে রাজপুরীর মধ্যে এক প্রকাণ্ড হাট-বাজার বসিয়া গেল। রাজকন্যার কৌটা দোকানীর কৌটার সঙ্গে মিশিয়া গেল। বুদ্ধু দেখিল, এ তো বেশ্‌। সে ঢোল—ডগর লইয়া বাজাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। ঢোল—ডগরের ডাহিনে ঘা দিলে হাট—বাজার বসে, বাঁয়ে ঘা দিলে হাট—বাজার ভাঙ্গিয়া যায়। বুদ্ধু চোখ বুজিয়া বসিয়া বসিয়া বাজাইতে লাগিল। দোকানীরা দোকান উঠাইতে—নামাইতে উঠাইতে নামাইতে একেবারে হয়রাণ হইয়া গেল, আর পারে না। তখন সকলে বলিল,— ‘রাখুন, রাখুন, রাজকন্যার কৌটা নেন; আমরা আর হাট করিতে চাহি না।’ বুদ্ধু ঢোল—ডগরের বাঁয়ে ঘা মারিল, হাট ভাঙিয়া গেল। কেবল রাজকন্যার কৌটাটি পড়িয়া রহিল। বুদ্ধু এবার আর কিন্তু ঢোলটি ছাড়িল না। ঢোলটি কাঁধে করিয়া কৌটার কাছে গিয়া ডাকিল,—

‘রাজকন্যা রাজকন্যা, ঘুমে আছ কি? বরে’ নিতে ঢোল-ডগর নিয়ে এসেছি।’

রাজকন্যা কৌটা হইতে বাহির হইয়া বলিলেন— ‘আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছে, গাছের—পাতার ফল আনিয়া দাও, খাইব।’
বুদ্ধু বলিল,— ‘আচ্ছা।’
রাজকন্যা কৌটায় উঠিলেন। বুদ্ধু ঢোল কাঁধে কৌটা হাতে গাছের পাতার-ফল আনিতে চলিল। সেখানে গিয়া বুদ্ধু দেখিল, গাছের পাতায়-পাতায় কত রকম ফল ধরিয়া রহিয়াছে। দেখিয়া বুদ্ধুরও লোভ হইল! কিন্তু, ও বাবা। এক যে অজগর গাছের গোড়ায় সোঁ সোঁ করিয়া ফোঁসাইতেছা!
বুদ্ধু তখন আস্তে আস্তে গাছের চারিদিকে ঘুরিয়া আসিয়া, এক দৌড় দিল। তাহার কোমরের সূতায় জড়াইয়া, অজগর, কাটিয়া দুইখান হইয়া গেল। তখন বুদ্ধু গাছে উঠিল, পাতার ফল পাড়িয়া, রাজকন্যাকে ডাকিল। রাজকন্যা বলিলেন,— ‘আর না, সব হইয়াছে। …. এখন চল, তোমার বাড়ী যাইব!’
বুদ্ধু বলিল,— ‘না সব হয় নাই; রাজপুত্রদাদাদিগে আর বুড়ীর কাঁথাটি লইতে হইবে।’ রাজকন্যা বলিলেন, ‘লও।’
তখন পাঁচ রাজপুত্র মাল্লা, মাঝি, ময়ূরপঙ্খী, সব লইয়া, ঢোল-ডগর কাঁধে, কৌটা হাতে, মোতির ফুল কানে, বুড়ীর কাঁথা গায়ে বুদ্ধু গাছের পাতার ফল খাইতে খাইতে কোমরের সূতায় টান দিল। ভূতুম্‌ বুঝিল এইবার বুদ্ধু আসিতেছে। সে সূতা টানিয়া তুলিল। পাঁচ রাজপুত্র, সিপাই-লস্কর, মাল্লা-মাঝি, ময়ূরপঙ্খী, সব লইয়া বুদ্ধু ভাসিয়া উঠিল। ভাসিয়া উঠিয়া মাল্লা-মাঝিরা, ‘সার্‌ সার্‌’ করিয়া পাল তুলিয়া দিল। বুদ্ধু গিয়া ময়ূরপঙ্খীর ছাদে বসিল, পেঁচা গিয়া ময়ূরপঙ্খীর মাস্তুলে বসিল। এবার সকলকে লইয়া ময়ূরপঙ্খী দেশে চলিল। ছাদের উপর বুদ্ধু চোখ মিটি-মিটি করে আর মাঝে-মাঝে কৌটা খুলিয়া কাহার সঙ্গে যেন কথা হয়, হা’লের মাঝি, যে রাজপুত্রদিগে এই খবর দিল।
খবর পাইয়া তাহারা চুপ। ….রাত্রে সকলে ঘুমাইয়াছে, ভূতুম্‌ আর বুদ্ধু ও ঘুমাইতেছে; সেই সময়, রাজপুত্রেরা চুপি—চুপি আসিয়া কৌটাটি সরাইয়া লইয়া, ঢোল-ডগর শিয়রে, বুড়ীর কাঁথা-গায়ে বুদ্ধুকে ধাক্কা দিয়া জলে ফেলিয়া দিলেন। ভূতুম্‌, মাস্তুলে ছিল, তার বুকে তীর মারিলেন। বুদ্ধু, ভূতুম্‌, জলে পড়িয়া ভাসিয়া গেল। তখন কৌটা খুলিতেই, মেঘবরণ চুল কুঁচ—বরণ রাজকন্যা বাহির হইলেন। রাজপুত্রেরা বলিলেন,— “রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?’ রাজকন্যা বলিলেন,— ‘ঢোল-ডগর যা’র।’ শুনিয়া রাজপুত্রেরা বলিলেন,— ‘ও! তা’ বুঝিয়াছি! রাজকন্যাকে আটক কর।’ কি করিবেন? রাজকন্যা ময়ূরপঙ্খীর এক কুঠরীর মধ্যে আটক হইয়া রহিলেন।

১৩

রহিলেন ‘ময়ূরপঙ্খী আসিয়া ঘাটে লাগিল, আর রাজ্যময় সাজ সাজ পড়িয়া গেল। রাজা আসিলেন, রাণীরা আসিলেন, রাজ্যের সকলে নদীর ধারে আসিল।’ মেঘ—বরণ চুল কুঁচ—বরণ কন্যা লইয়া রাজপুত্রেরা আসিয়াছেন। রাণীরা ধান-দূর্বা দিয়া, পঞ্চদীপ সাজাইয়া, শাঁখ শঙ্খ বাজাইয়া কলাবতী রাজকন্যাকে বরণ করিয়া ঘরে তুলিলেন।
রাজকন্যা বলিলেন,—

‘ঢোল-ডগর যা’র।’
‘ঢোল-ডগর হীরারাজপুত্রের?
‘ ‘না।’
‘ঢোল-ডগর মাণিকরাজপুত্রের?’
‘না’
‘ঢোল-ডগর মোতিরাজপুত্রের?’
‘না’
‘ঢোল-ডগর শঙ্খরাজপুত্রের?’
‘না’
‘ঢোল-ডগর কাঞ্চনরাজপুত্রের?’
‘না।’
রাণীরা বলিলেন,— ‘তবে তোমাকে কাটিয়া ফেলিব।’ রাজকন্যা বলিলেন,— ‘আমার একমাস ব্রত, একমাস পরে যাহা ইচ্ছা করিও।’
তাহাই ঠিক হইল।

(১৪)

ভূতুমের মা, বুদ্ধুর মা, এতদিন কাঁদিয়া কাঁদিয়া মর’মর। শেষে দুইজনে নদীর জলে ডুবিয়া মরিতে গেলেন। এমন সময় একদিক হইতে বুদ্ধু ডাকিল,— ‘মা!’ আর একদিক হইতে ভূতুম্‌ ডাকিল,— ‘মা’ দীন-দুঃখিনী দুই মায়ে ফিরিয়া চাহিয়া দেখেন,—

বুকের ধন হারামণি বুদ্ধু আসিয়াছে!
বুকের ধন হারামণি ভূতুম্‌ আসিয়াছে!
বুদ্ধুর মা, ভূতুমের মা, পাগলের মত হইয়া ছুটিয়া গিয়া দুইজনে দুইজনকে বুকে নিলেন। বুদ্ধু ভূতুমের চোখের জলে, তাঁহাদের চোখের জলে, পৃথিবী ভাসিয়া গেল।
বুদ্ধু ভূতুম্‌ কুঁড়েয় গেল।
পরদিন, সেই যে ঢোল-ডগর ছিল? চিড়িয়াখানার বাঁদী, ঘুঁটে-কুড়ানী দাসীর কুঁড়ের কাছে, মস্ত হাট-বাজার বসিয়া গিয়াছে। দেখিয়া লোক অবাক হইয়া গেল।
তাহার পরদিন, চিড়িয়াখানার বাঁদী, ঘুঁটে—কুড়ানী দাসীর কুঁড়ের চারিদিকে গাছের পাতায় পাতায় ফল ধরিয়াছে! দেখিয়া লোকেরা আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেল।
তাহার পরদিন, চিড়িয়াখানার বাঁদি, ঘুঁটে—কুড়ানী দাসীর কুঁড়ে ঘিরিয়া লক্ষ সিপাই পাহারা দিতেছে! দেখিয়া লোক সকল চমকিয়া গেল।
সেই খবর যে, রাজার কাছে গেল।
যাইতেই, সেইদিন কলাবতী রাজকন্যা বলিলেন,— ‘মহারাজ আমার ব্রতের দিন শেষ হইয়াছে; আমাকে মারিবেন, কি, কাটিবেন, কাটুন।’ শুনিয়া রাজার চোখ ফুটিল।’ রাজা সব বুঝিতে পারিলেন। বুঝিয়া রাজা বলিলেন, ‘মা, আমি সব বুঝিয়াছি। কে আমার আছ, ন’রাণীকে আর ছোটরাণীকে ডোল—ডগর বাজাইয়া ঘরে আন।’
অমনি রাজপুরীর যত ঢাক ঢোল বাজিয়া উঠিল। কলাবতী রাজকন্যা, নূতন জলে স্নান, নূতন কাপড়ে পরণ, ব্রতের ধান-দূর্বা মাথায় গুঁজিয়া, দুই রাণীকে বরণ করিয়া আনিতে আপনি গেলেন।
শুনিয়া, পাঁচরাণী ঘরে গিয়া খিল দিলেন। পাঁচ রাজপুত্র ঘরে গিয়া কবাট দিলেন। লক্ষ সিপাই লইয়া, ঢোল-ডগর বাজাইয়া ন’রাণী ছোটরাণীকে নিয়া কলাবতী রাজকন্যা রাজপুরীতে ফিরিয়া আসিলেন। বুদ্ধু ভূতুম্‌ আসিয়া রাজাকে প্রণাম করিল।
পরদিন মহা ধুম-ধামে মেঘবরণ চুল কুঁচবরণ কলাবতী রাজকন্যার সঙ্গে বুদ্ধুর বিবাহ হইল। আর একদেশের রাজকন্যা হীরাবতীর সঙ্গে ভূতুমের বিবাহ হইল।
পাঁচ রাণীরা আর খিল খুলিলেন না! পাঁচ রাজপুত্রেরা আর কবাট খুলিলেন না! রাজা পাঁচ রাণীর আর পাঁচ রাজপুত্রের ঘরের উপরে পাঁটা দিয়া, মাটি দিয়া, বুজাইয়া দিলেন।
ক’দিন যায়। একদিন রাত্রে, বুদ্ধুর ঘরে বুদ্ধু, ভূতুমের ঘরে ভূতুমের ঘরে ভূতুম্‌, কলাবতী রাজকন্যা হীরাবতী রাজকন্যা ঘুমে। খুব রাত্রে হীরাবতী কলাবতী উঠিয়া দেখেন, ‘একি! হীরাবতীর ঘরে তো সোয়ামী নাই! কলাবতীর ঘরেও তো সোয়ামী নাই!’ কি হইল, কি হইল? দেখেন,— বিছানার উপরে এক বানরের ছাল, বিছানার উপরে এক পেঁচার পাখ!!
‘অ্যাঁ—দ্যা‍খ্‌‍!— তবে তো এঁরা সত্যিকার বানর না, সত্যিকার পেঁচা না। ‘দুই বোনে ভাবেন— ভাবিয়া শেষে উঁকি দিয়া দেখেন—দুই রাজপুত্র ঘোড়ায় চাপিয়া রাজপুরী পাহারা দেয়। রাজপুত্রেরা যে দেবতার পুত্রের মত সুন্দর!
তখন, দুই বোনে যুক্তি করিয়া তাড়াতাড়ি পেঁচার পাখ বানরের ছাল প্রদীপের আগুনে পোড়াইয়া ফেলিলেন। পোড়াতেই,— গন্ধ!
গন্ধ পাইয়া দুই রাজপুত্র ঘোড়া ফেলিয়া ছুটিয়া আসিলেন। ছুটিয়া আসিয়া দেবকুমার দুই রাজপুত্র বলেন,— ‘সর্বনাশ, সর্বনাশ! এ কি করিলে! ‘ সন্ন্যাসীর মন্ত্র ছিল, ছদ্মবেশে থাকিতাম, দেবপুরে যাইতাম আসিতাম, রাজপুরে পাহারা দিতাম,— আর তো সে সব করিতে পারিব না!— এখন, আর তো আমরা বানর পেঁচা হইয়া থকিতে পারিব না!—কথা যে, প্রকাশ হইল!’
দুই রাজকন্যা ছিলেন থতমত, হাসিয়া বলিলেন,— ‘তা’র আর কি? তবে তো ভালোই, তবে তো বেশ হইল। ও মা তবে না—কি পেঁচা?—তবে না কি বানর? আমরা কোথায় যাই!—’
দুই রাজকন্যার ঘরে, আর কি?— সুখের নিশি, সুখের হাট। তা’র পরদিন ভোরে উঠিয়া সকলে দেখে, দেবতার মত মূর্তি দুই সোনার চাঁদ রাজপুত্র রাজার দুই পাশে বসিয়া আছে! দেখিয়া সকল লোকে চমৎকার মানিল। কলাবতী রাজকন্যা বলিলেন, ‘উনি বানরের ছাল গায়ে দিয়া থাকিতেন; কা’ল রাত্রে আমি তাহা পোড়াইয়া ফেলিয়াছি।’
আর একদেশের রাজকন্যা হীরাবতী বলিলেন,—’উনি পেঁচার পাখ গায়ে দিয়া থাকিতেন, কা’ল আমি তাহা পোড়াইয়া ফেলিয়াছি।’
শুনিয়া সকলে ধন্য ধন্য করিল।
তা’রপর?— তা’রপর—
বুদ্ধুর নাম হইয়াছে—বধুকুমার,
ভূতুমের নাম হইয়াছে—রূপকুমার।
রাজ্যে আনন্দের জয়—জয়কার পড়িয়া গেল।
তাহার পর, ন—রাণী, ছোটরাণী, বুধকুমার, রূপকুমার আর কলাবতী রাজকন্যা, হীরাবতী রাজকন্যা, লইয়া, রাজা সুখে দিন কাটাইতে লাগিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *