বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ১০]
বাংলা বর্ণমালায় ‘অ্যা’-স্বরের কোনও বর্ণরূপ না থাকলেও বর্তমানে এর ধ্বনিরূপটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ‘অ্যা’ ধ্বনি ব্যবহারের বিভিন্ন নিয়ম উল্লেখ করেছেন। যেমন :
১) বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে অ্যা ধ্বনি দিয়ে উচ্চারণ শুরু এমন শব্দের প্রথম বর্ণে সর্বত্রই ‘অ্যা’ ব্যবহারয়োগ্য। যেমন : অ্যাংলো, অ্যাকাউন্ট, অ্যাক্ট, অ্যাটাক, অ্যাকাডেমি (‘আকাদেমি’ ইংরেজি-ভিন্ন অন্য সূত্র থেকে গৃহীত একটি পৃথক শব্দ, তার বানানও ভিন্ন) অ্যান্ড, অ্যাভিনিউ, অ্যালুমিনিয়াম, অ্যাপ্লিকেশন ইত্যাদি।
২) ব্যঞ্জনপরবর্তী উচ্চারণে ‘-্যা’ অনুরূপভাবে এই সব ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। যেমন : ক্যাচ, ক্যানভাস, গ্র্যাজুয়েট, চ্যানেল, গ্র্যান্ড, ড্যাশ, ন্যান্সি, প্যাক, ফ্যাক্টরি, ব্যাংক, ব্যালাড, ব্যালান্স, হ্যাট, হ্যালো ইত্যাদি।
৩) বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য যে-সব অর্ধতৎসম, তদ্ভব ও অজ্ঞাতমূল শব্দ ‘অ্যা’ বা ‘-্যা’ দিয়ে লেখা যাবে তার সংক্ষিপ্ত তালিকা : অ্যাদ্দিন, ক্যাবলা, খ্যাঁকশেয়াল, খ্যাপা, গ্যাঁড়াকল, চ্যাঁংড়া, ঠ্যাং, থ্যাঁতলা, ত্যাঁদড়, ন্যাকা, ন্যাড়া, ফ্যাকাশে, শ্যাওলা, স্যাঙাত, হ্যাঁচকা ইত্যাদি।
৪) তৎসম শব্দের ‘-্যা’ ধ্বনি বজায় থাকবে। যেমন : খ্যাত, ব্যাঘাত, ব্যাপ্ত, ব্যায়াম, ব্যাস ইত্যাদি।
৫) কিছু শব্দের উচ্চারণে ‘অ্যা’ ধ্বনি থাকলেও এ বা এ-কার দেওয়াই সংগত। যেমন : একলা, একা, এখন, এগারো, এত, এমন, কেমন, খেলনা, খেলা, ডেলা, মেলা, ভেলা, যেন, হেন ইত্যাদি। বাংলা শব্দভাণ্ডারে এই ধরনের তদ্ভব শব্দ অনেক।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৯]
শব্দের সঙ্গে সংযুক্ত ‘কে’ এবং বিযুক্ত ‘কে’-এর ব্যবহার কেন জানতে হবে?
১) রামকে ডাকো? ( এখানে ‘কে’ হল বিভক্তি। বিভক্তিটি উক্ত নামপদের (‘রাম’) কারক নির্দেশ করছে। বাক্যটির অর্থ হল— রাম নামক ব্যক্তিকে ডাকো।
২) রাম কে ডাকো? (এখানে ‘কে’ কিন্তু প্রশ্নসূচক অব্যয়। বাক্যটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে— বক্তা রামকে চেনেন না, তাকে ডাকতে বলছেন।)
[যদিও বাক্যটি লেখা উচিত এইভাবে— ‘কে রাম? ডাকো?’ বা নিতান্ত ‘রাম কে, ডাকো?’
৩) রামের সঙ্গে কে এল বাড়িতে? (এখানে আবার ‘কে’ হল প্রশ্নসূচক সর্বনাম। অর্থাৎ ‘কে’ এখানে একজন ব্যক্তি, যার পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছে।)
# এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, ‘কে’-কে শব্দের সঙ্গে যুক্ত এবং বিযুক্ত করে লিখলে তার অর্থের তারতম্য ঘটছে। তাই এ বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৮]
দেওয়া না কি দেয়া, নেওয়া না কি নেয়া ?
লেখার ক্ষেত্রে সাধু ও চলিত উভয় রীতিতেই দেওয়া, নেওয়া ব্যবহৃত হয়; দেয়া, নেয়া ব্যবহারের প্রচলন খুবই কম। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর রচনায় অনেক ক্ষেত্রে দেয়া, নেয়া ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু কথা বলার সময় শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেশিরভাগ বাঙালিই দেয়া, নেয়া ব্যবহার করে থাকেন।
দেওয়া বা দেয়া, নেওয়া বা নেয়া উভয়ই ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে, একই রচনায় যেন দেওয়া ও দেয়া কিংবা নেওয়া ও নেয়া ব্যবহৃত না হয়।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৭]
‘ওনার’, ‘উনারা’, ‘তেনার’, ‘তেনারা’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করবেন, না করবেন না ?
১) এগুলি আসলে প্রথম পুরুষের (Third Person) সর্বনাম পদ। এগুলোকে শুদ্ধ প্রয়োগ বলা যায় না। তবে অনেকেই আঞ্চলিক প্রয়োগ অর্থে লিখে থাকেন। এখন তাঁরা জেনে লেখেন, না কি না-জেনে সেটা বলা মুশকিল!
২) শুদ্ধ প্রয়োগগুলি হল— ‘উনি’ সঠিক। কিন্তু ‘উনার’ (বা ওনার) সঠিক নয়, সর্বনামটি আসলে ‘ওঁর’। ‘তিনি’ সঠিক। কিন্তু ‘তেনার’ নয় ‘তাঁর’, ‘তেনারা’ নয় ‘তাঁরা’।
৩) প্রাসঙ্গিকভাবে বলা প্রয়োজন, অনেকে মধ্যম পুরুষ (Second Person) এবং প্রথম পুরুষ (Third Person)-এর সর্বনামের ক্ষেত্রে বিভেদ খেয়াল করেন না। যেমন : মধ্যম পুরুষে ‘যারা’, তারা, ‘যাদের’, ‘তাদের’; কিন্তু প্রথম পুরুষে ‘যাঁরা’, ‘তাঁরা’, ‘যাঁদের’, ‘তাঁদের’।
উদাহরণ : তারা আজ আসবে। তাঁরা আজ আসবেন।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৬]
হ্রস্ব ‘ই’-কার ও দীর্ঘ ‘ঈ’-কারের বানান রীতি
১) তৎসম শব্দের ( অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দ সংস্কৃত থেকে অবিকৃত ভাবে বাংলা ভাষার গৃহীত হয়েছে ) হ্রস্ব ‘ই’-কার ও দীর্ঘ ‘ঈ’-কার অপরিবর্তিত থাকবে।
# তবে যে সমস্ত তৎসম শব্দে হ্রস্ব ‘ই’-কার ও দীর্ঘ ‘ঈ’-কার উভয়ই প্রচলিত সেখানে হ্রস্ব বিকল্পটি গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। যেমন— অঙ্গুলি, অঙ্গুরি, চিৎকার, ত্রুটি, ধরণি, শ্রেণি, সরণি, সারণি, বেণি, বেদি, পদবি, সূচি, নাড়ি, পল্লি, পঞ্জি ইত্যাদি।
২) তদ্ভব শব্দে ( অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দ সংস্কৃত থেকে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে ) দীর্ঘ ‘ঈ’-কার পরিহার করে হ্রস্ব ‘ই’-কার ব্যবহার করতে হবে। যেমন— পক্ষী>পাখি, হস্তী>হাতি, সখী>সই ইত্যাদি। আরো উদাহরণ— কাহিনি, বহিন(বোন), ঘি, মিঠা ইত্যাদি।
৩) বাংলা শব্দভাণ্ডারে গৃহীত বিদেশি শব্দে প্রায় সর্বত্রই দীর্ঘ ‘ঈ’-কারের পরিবর্তে হ্রস্ব ‘ই’-কার হবে। যেমন—
আরবি : গরিব, দলিল, দাখিল, দাবি, নজির, ইমান, ইদ, উকিল, খাতির, তারিখ, জিলা, মুহুরি ইত্যাদি।
# বাংলা একাডেমি ঢাকা ব্যতিক্রম হিসেবে ‘ঈদ’ রাখার পক্ষপাতী।
ফারসি : উকিল, উজির, খরিদ, খাকি, জমি, চাকরি, দাবি, নালিশ, হিসাব, শহিদ, বাগিচা, বরফি, নিমকি, বন্দি, বেশি(>বেশ), তৈরি(>তইয়ার্) ইত্যাদি।
ইংরেজি : টেবিল, সিনেমা, কোম্পানি, কমিটি, মিনিট, টিকিট, টিন, টিম, লিগ, লিড, লেডি, রিড, সিড, স্টিল, স্ট্রিট, ফ্রি, রেফারি, সেক্রেটারি, নার্সারি, জানুয়ারি ইত্যাদি।
৪) বিদেশি বা অ-তৎসম শব্দে সংস্কৃত -ঈয় প্রত্যয় যুক্ত হলে দীর্ঘ ‘ঈ’-কার বজায় থাকবে। যেমন— এশীয়, ইউরোপীয়, অস্ট্রেলীয়, ইতালীয় ইত্যাদি।
৫) অ-তৎসম শব্দে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝানোর ক্ষেত্রে হ্রস্ ‘ই’-কার ব্যবহার হবে। যেমন— কাকি, খুকি, চাকরানি, চাচি, ছুঁড়ি, ঠাকুরানি, পাগলি, পিসি, বেটি, মামি, রানি ইত্যাদি।
৬) জীবিকা ও ভাষা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও ই-কারান্ত প্রত্যয়ে হ্রস্ব ‘ই’-কার হবে। যেমন— ওকালতি, জমিদারি, ডাকাতি, ডাক্তারি, নবাবি, মাতব্বরি, মাস্টারি ইত্যাদি অথবা আরবি, ফারসি, ফরাসি, মারাঠি, ইরাকি, জাপানি, পশ্চিমি, বাঙালি, বাংলাদেশি, বিহারি ইত্যাদি।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৫]
টা, টি, খানি, গুলো, গুচ্ছ — ইত্যাদি কীভাবে বসবে?
এগুলিকে বলা হয় নির্দেশক (specifier)। এগুলি ব্যক্তি বা বস্তুর সংখ্যা, পরিমাণ নির্দেশ করে। একবচনের নির্দেশক— টি, টা, টুকু, টুকুন, খান, খানি, ইত্যাদি; বহুবচনের নির্দেশক— গুলি, গুলো, বৃন্দ, রাশি, গুচ্ছ, পুঞ্জ ইত্যাদি। নির্দেশক (দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) বিশেষ্যের শেষে বিশেষ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বসে। যেমন:
১) পাখিটি খাঁচা থেকে উড়ে গেল।
২) প্রত্যেকের ভালো গুণটা গ্রহণ করবে।
ক) বইগুলো গুছিয়ে রাখো।
খ) সদস্যবৃন্দ আলোচনা শেষ করে উঠলেন।
ব্যতিক্রম :
# খানদশেক রুটি সে নিমেষেই খেতে পারে।
[এখানে নির্দেশকটি (‘খান’) শব্দের শেষে সংযুক্ত হয়ে না বসে, শব্দের শুরুতে বসেছে।]
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৪]
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ৩]
পরপদে গাছ, পাখি ইত্যাদি থাকলে কীভাবে বসবে?
উপরিউক্ত শব্দগুলি পরপদে থাকলে তা প্রথম পদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বসবে না আলাদা বসবে তা নির্ভর করবে প্রথম শব্দটি ছোটো না বড়ো তার উপর।
১) যেমন: বটগাছ, আমগাছ, জামগাছ; কিন্তু নারকেল গাছ, জামরুল গাছ ইত্যাদি।
২) যেমন: উটপাখি, টিয়াপাখি; কিন্তু কাকাতুয়া পাখি, শালিখ পাখি ইত্যাদি।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ২]
‘কি’ এবং ‘কী’ — এর ব্যবহার।
১. ‘কি’ একটি প্রশ্নসূচক অব্যয়। হ্যাঁ বা না-তে উত্তর দেওয়া যাবে এমন ক্ষেত্রে ‘কি’-র ব্যবহার হবে। যেমন: আপনি কি ভাত খাবেন?, আপনি কি সঠিক সময়ে আসতে পারবেন?, আপনার কি এখন কাজ আছে?
২.ক) ‘কী’ একটি প্রশ্নসূচক সর্বনাম। হ্যাঁ বা না-তে এর উত্তর হবে না। যেমন: আপনি কী খাবেন? — এই প্রশ্নের উত্তরে ভাত, মুড়ি, রুটি যা খুশি বসতে পারে। উদাহরণ: কী ওটা?, তুমি কী করবে এখন?, কী বিষয় বলো তো?
খ) ‘কী’ আবার একটি বিস্ময়বোধক অব্যয়ও। যেমন: কী সুন্দর দৃশ্য! , কী মজা!
বি.দ্র.— প্রাচীন পদকর্তারা নির্বিচারে ‘কি’ ও ‘কী’ লিখতেন। রবীন্দ্রনাথই প্রথম ‘কি’ ও ‘কী’-র অর্থভেদের পক্ষে মত দেন। তবে এখনও বহু সাহিত্যিক একটা ‘কি’ লেখারই পক্ষপাতী।
বাংলা শিখি বাংলা লিখি [পর্ব: ১]
‘না’ ও ‘নি’ — এর অবস্থান
১) ‘নি’ সবসময় আগের শব্দের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বসবে। যেমন— শোনেনি, বলেনি, বলেননি, হাসেননি, খাননি, পাননি ইত্যাদি।
২) ‘না’ সব সময় আগের শব্দের থেকে বিযুক্ত/আলাদা হয়ে বসবে। যেমন— খাব না, যাব না, বলব না, করব না, দেখবে না, হাসবে না, খেলতাম না, দেখতাম না ইত্যাদি।
[ব্যতিক্রম— কেননা। কারণ ‘কেননা’ নিজেই একটি শব্দ।]