বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ
মুচিরাম গুড় মহাশয় এই জগৎ পবিত্র করিবার জন্য, কোন্ শকে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, ইতিহাস তাহা লেখে না। ইতিহাস এরূপ অনেকপ্রকার বদমাইশি করিয়া থাকে। এ দেশে ইতিহাসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না, নচেৎ উচিত ব্যবস্থা করা যাইত।
যশোদা দেবীর গর্ভে সাফলরাম গুড়ের ঔরসে তাঁহার জন্ম। ইহা দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই; কেন-না, উচ্চবংশের কথা কিছুই বলিতে পারা গেল না। তবে ইহা বলা যাইতে পারে যে, তিনি ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব। গুড় শুনিয়া কেহ মনে না করেন যে, তিনি মিষ্টবিশেষ হইতে জন্মিয়াছিলেন।
সাফলরাম গুড় কৈবর্ত্তের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার নিবাস সাধুভাষায় মোহনপল্লী, অপর ভাষায় মোনাপাড়া। মোহনপল্লী ওরফে মোনাপাড়ায় কেবল ঘর কতক কৈবর্ত্তের বাস। গুড় মহাশয় মোনাপাড়ায় একমাত্র ব্রাহ্মণ-যেমন এক চন্দ্র রজনী আলোকময়ী করেন, যেমন এক সূর্য্যই দিনমণি, যেমন এক বার্ত্তাকুদগ্ধ গুড় মহাশয়ের অন্নরাশির উপর শোভা করিতেন, তেমনি সাফলরাম এক ব্রাহ্মণ মোহনপল্লী উজ্জ্বল করিতেন। শ্রাদ্ধশান্তিতে কাঁচা পাকা কদলী, আতপ তণ্ডুল এবং দক্ষিণা, ষষ্ঠী মাকালের পূজায়, অন্নপ্রাশনাদিতে নারিকেল নাড়ু, ছোলা, কলা আদি তাঁহার লাভ হইত। সুতরাং যাজনক্রিয়ায় তাঁহার বিশেষ মনোযোগ ছিল। তাঁহারই ঐশ্বর্য্যের উত্তরাধিকারী এবং তদর্জ্জিত রম্ভাভোজনের হক্দার হইয়া মুচিরাম শুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করিলেন।
জন্মগ্রহণের পর মুচিরাম দিনে দিনে বাড়িতে লাগিলেন। দেখিয়া যশোদা, সেটা বালকের অসাধারণ পৌরুষের লক্ষণ বিবেচনা করিয়া, অতিশয় গর্ব্বান্বিতা হইলেন। যথাকালে মুচিরামের অন্নপ্রাশন হইল। নামকরণ হইল মুচিরাম। এত নগেন্দ্র গজেন্দ্র চন্দ্রভূষণ বিধুভূষণ থাকিতে তাঁহার মুচিরাম নাম হইল কেন, তাহা আমি সবিশেষ জানি না, তবে দুষ্ট লোকে বলিত যে, যশোদা দেবীর যৌবনকালে কোন কালো-কোলো কোঁক্ড়াচুল নধরশরীর মুচিরাম দাস নামা কৈবর্ত্তপুত্র তাঁহার নয়নপথের পথিক হইয়াছিল, সেই অবধি মুচিরাম নামটি যশোদার কাণে মিষ্ট লাগিত।
যাহাই হউক, যশোদা নাম রাখিলেন মুচিরাম। নাম পাইয়া মুচিরাম শর্ম্মা দিনে দিনে বাড়িতে লাগিলেন। ক্রমে “মা,” “বাবা”, “দু”, “দে” ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করিতে শিখিলেন। তাঁহার অসাধারণ ধীশক্তির বলে মিছাকান্নায় এক বৎসর পার হইতে না হইতেই সুপণ্ডিত হইলেন। তিন বৎসর যাইতে না যাইতেই গুরুভোজনে দোষ উপস্থিত হইল এবং পাঁচ বৎসর যাইতে না যাইতেই মহামতি মুচিরাম মাকে পিতৃ উচ্চারণ করিতে এবং বাপকে শালা বলিতে শিখিলেন। যশোদা কাঁদিয়া বলিতেন, এমন গুণের ছেলে বাঁচ্লে হয়।
পাঁচ বৎসরে সাফলরাম গুড় মহাশয় কিছু গোলে পড়িলেন। যশোদা ঠাকুরাণীর সাধ, পাঁচ বৎসরে পুত্রের হাতে খড়ি হয়। সর্ব্বনাশ! সাফলরামের তিন পুরুষের মধ্যে সে কাজ হয় নাই। মাগী বলে কি? যে দিন কথা পড়িল, সে দিন সাফলরামের নিদ্রা হইল না।
যমুনার জল উজান বহিতে পারে, তবু গৃহিণীর বাক্য নড়িতে পারে না। সুতরাং সাফলরাম হাতে খড়ির উদ্যোগ দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিন ক্রোশের মধ্যে পাঠশালা বা গুরু মহাশয় নাই। কে লেখাপড়া শিখাইবে? সাফলরাম বিষণ্ণবদনে বিনীতভাবে যশোদা দেবীর শ্রীপাদপদ্মে এই সম্বাদ-সুনিবেদিত হইলেন। যশোদা বলিলেন, “ভাল, তুমি কেন আপনিই হাতে খড়ি দিয়া ক, খ শিখাও না |” সাফলরাম একটু ম্লান হইয়া বলিলেন, “হাঁ, তা আমি পারি, তবে কি জান, শিষ্যসেবক যজমানের জ্বালায়—আজি কি রান্না হইল?” শুনিবামাত্র যশোদা দেবীর মনে পড়িল, আজি কৈবর্ত্তেরা পাতিলেবু দিয়া গিয়াছে। বলিলেন, “অধঃপেতে মিন্সে—” এই বলিয়া পতিপুত্রপ্রাণা যশোদা দেবী বিষণ্ণমনে সজলনয়নে পাতিলেবু দিয়া পান্তা ভাত খাইতে বসিলেন।
অগত্যা মুচিরাম অন্যান্য বিদ্যা অভ্যাসে সানুরাগ হইলেন। অন্যান্য বিদ্যার মধ্যে— “পরা অচরা চ”—গাছে ওঠা, জলে ডোবা, এবং সন্দেশ চুরি। কৈবর্ত্ত যজমানদিগের কল্যাণে গুড়ের ঘরে সন্দেশের অভাব নাই। নারিকেলসন্দেশ এবং অন্যান্য যে সকল জাতীয় সন্দেশের সঙ্গে ছানার সাক্ষাৎ বা অসাক্ষাৎ কোন প্রকার সম্বন্ধ নাই, যাহা সর্ব্বদা মুচিরামের ঘরে থাকিত, সে সকল মুচিরামের বিদ্যাভ্যাসের কারণ হইল। কৈবর্ত্তের ছেলেদের সঙ্গে মুচিরামের প্রত্যহ একটি নূতন কোন্দল হইত-শুনা গিয়াছে, কৈবর্ত্তদিগের ঘরেও খাবার চুরি যাইত।
নবম বৎসরে মুচিরামের উপনয়ন হইল। তার পর সাফলরাম এক বৎসর প্রিয়তম পুত্রকে সন্ধ্যা আহ্নিক শিখাইলেন। এক বৎসরে মুচিরাম সন্ধ্যা আহ্নিক শিখিয়াছিলেন কি না, আমরা জানি না। কেন না, প্রমাণাভাব। তার পর মুচিরাম কখন সন্ধ্যা আহ্নিক করেন নাই।
তৎপরে একদিন সাফলরাম গুড় অকস্মাৎ ওলাওঠারোগে প্রাণত্যাগ করিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যশোদার আর দিন যায় না। যজমানদিগের পৌরাহিত্য কে করে? কৈবর্ত্তেরা আর এক ঘর বামন আনিল। যশোদা অন্নকষ্টে-ধান ভানিতে আরম্ভ করিলেন।
যখন মুচিরামের বয়স দশ বৎসর, কৈবর্ত্তেরা চাঁদা করিয়া একটা বারোইয়ারি পূজা করিল। যাত্রা দিবার জন্য বারোইয়ারি; কৈবর্ত্তেরা শস্তা দরে হারাণ অধিকারীকে তিন দিনের জন্য বায়না করিয়া আনিয়া, কলাগাছের উপর সরা জ্বালিয়া, তিন রাত্রি যাত্রা শুনিল। মুচিরাম এই প্রথম যাত্রা শুনিল। যাত্রার গান, যাত্রার গল্প অনেক শুনিয়াছিল-কিন্তু একটা আস্ত-যাত্রা এই প্রথম শুনিল; চূড়া ধড়া ঠেঙ্গা লাঠি সহিত সাক্ষাৎ কৃষ্ণ এই প্রথম দেখিল। আহ্লাদে উছলিয়া উঠিল। নিশ্চিত সম্বাদ রাখি যে, পরদিন মুচিরাম, গালাগালি মারামারি বা চুরি বা মাতাকে প্রহার, এ সকলের কিছুই করে নাই।
মুচিরামের একটা গুণ ছিল, মুচিরাম সুকণ্ঠ। প্রথম দিন যাত্রা শুনিয়া, বহু যত্নে একটা গানের মোহাড়াটা শিখিয়াছিল। পরদিন হইতে মাঠে মাঠে সেই গান গাইয়া ফিরিতে লাগিল। দৈবাৎ হারাণ অধিকারী লোটা হাতে, পুষ্করিণীতে হস্তমুখপ্রক্ষালনাদির অনুরোধে যাইতেছিলেন-প্রভাতবায়ুপরিচালিত হইয়া মুচিরামের সুস্বর অধিকারী মহাশয়ের কাণের ভিতর গেল। কাণে যাইতে যাইতে মনের ভিতর গেল,-মনের ভিতর গিয়া, কল্পনার সাহায্যে টাকার সিন্দুকের ভিতরেও প্রবেশ করিল। অধিকারী মহাশয়ের নিকট গলার আওয়াজ, টাকার আওয়াজে পরিণত হয়। সে দোষে অধিকারী মহাশয় একা দোষী নহেন-জিজ্ঞাসা করিলে অনেক উকীল মহাশয়েরা ইহার কিছু নিগূঢ় তত্ত্ব বলিয়া দিতে পারিবেন। তাঁহাদের কাছেও গলার আওয়াজ টাকার আওয়াজে পরিণত হয়। উকীলবাবুদেরই বা দোষ কি-Glorious British Constitution! হায়! গলাবাজি সার!
অধিকারী মহাশয়-মানুষের সঙ্গে প্রেম করেন না-ব্রিটিষ পার্লিয়মেণ্টের মত এবঞ্চ কুরঙ্গিণীসদৃশ, মনুষ্যকণ্ঠেই মুগ্ধ-অতএব তিনি হাত নাড়িয়া মুচিরামকে ডাকিলেন। মুচিরাম আসিল। তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া বলিলেন, “তুমি আমার যাত্রার দলে থাকিবে?”
মুচিরাম আহ্লাদে আটখানা। মাকে জিজ্ঞাসার অপেক্ষা রাখিল না-তখনই সঙ্গে যায়। কিন্তু অধিকারী মনে করিল যে, পরের ছেলে না বলিয়া লইয়া যাওয়া কিছু নয়। অতএব মুচিরামকে সঙ্গে করিয়া তাহার মার নিকট গেল।
শুনিয়া যশোদা বড় কাঁদা কাটা আরম্ভ করিল-সবে একটি ছেলে-আর কেহ নাই-কি প্রকারে ছাড়িয়া দিবে? এদিকে আবার অন্ন জুটে না-যদি একটা খাবার উপায় হইতেছে-কেমন করিয়াই বা না বলে? বিধাতা কি আর এমন সুযোগ করিযা দিবেন? আমি না দেখিতে পাই, তবু ত মুচিরাম ভাল খাইবে, ভাল থাকিবে, ভাল পরিবে। যশোদা যাত্রাওয়ালার দু:খ জানিত না। অগত্যা পাঁচ টাকা মাসিক বেতন রফা করিয়া যশোদা মুচিরামকে হারাণ অধিকারীর হস্তে সমর্পণ করিল। তার পর আছাড়িয়া পড়িয়া স্বামীর জন্য কাঁদিতে লাগিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মুচিরাম অল্পদিনেই জানিল যে, যাত্রাওয়ালার জীবন সুখের নয়। যাত্রাওয়ালা কেবল কোকিলের মত গান করিয়া ডালে ডালে মুকুল ভোজন করিয়া বেড়ায় না। অল্পদিনে মুচিরামের শরীর শীর্ণ হইল। এ গ্রাম ও গ্রাম ছুটাছুটি করিতে সকল দিন আহার হয় না; রাত্রি জাগিয়া প্রাণ ওষ্ঠাগত; চুলের ভারে মাথায় উকুনে ঘা করিল; গায়ে খড়ি উড়িতে লাগিল; অধিকারীর কাণমলায় কাণমলায় দুই কাণে ঘা হইল। শুধু তাই নয়; অধিকারী মহাশয়ের পা টিপিতে হয়, তাঁকে বাতাস করিতে হয়, তামাক সাজিতে হয়, আরও অনেক রকম দাসত্ব করিতে হয়। অল্পদিনেই মুচিরামের সোণার মেঘ বাষ্পরাশিতে পরিণত হইল।
মুচিরামের আরও দুর্ভাগ্য এই যে, বুদ্ধিটা বড় তীক্ষ্ণ নহে। গীতের তাল যে, পুষ্করিণীতীরস্থ দীর্ঘ বৃক্ষে ফলে না, ইহা বুঝিতে তাহার বহুকাল গেল। ফলে তালিমের সময়ে তালের কথা পড়িলে, মুচিরাম অন্যমনস্ক হইত-মনে পড়িত, মা কেমন তালের বড়া করে!-মুচিরামের চক্ষু দিয়া এবং রসনা দিয়া জল বহিয়া যাইত।
আবার গান মুখস্থ করা আরও দায়-কিছুতেই মুখস্থ হইত না-কাণমলায় কাণমলায় কাণ রাঙ্গা হইয়া গেল। সুতরাং আসরে গায়িবার সময়ে পিছন হইতে তাহাকে বলিয়া দিতে হইত। তাহাতে মধ্যে মধ্যে বড় গোল বাঁধিত-সকল সময়ে ঠিক শুনিতে বা বুঝিতে পারিত না। একদিন পিছন হইতে বলিয়া দিতেছে-
“নীরদকুন্তলা-লোচনচঞ্চলা
দধতি সুন্দররূপং”
মুচিরাম গায়িল-“নীরদ কুন্তলা__” থামিল-আবার পিছন হইতে বলিল, “লোচনচঞ্চলা”-মুচিরাম ভাবিয়া চিন্তিয়া গায়িল, “লুচি চিনি ছোলা”। পিছন হইতে বলিয়া দিল, “দধতি সুন্দররূপং”-মুচিরাম না বুঝিয়া গায়িল, “দধিতে সন্দেশ রূপং”। সেদিন আর গায়িতে পাইল না।
মুচিরামকে কৃষ্ণ সাজিতে হইত-কিন্তু কৃষ্ণের বক্তব্য সকল তাহাকে পিছন হইতে বলিয়া দিতে হইত-“আ-বা-আ-বা ধবলী”টি মুখস্থ ছিল। একদিন মানভঞ্জন যাত্রা হইতেছে-পিছন হইতে মুচিরামকে বক্তৃতা শিখাইয়া দিতেছে। কৃষ্ণকে বলিতে হইবে, “মানময়ি রাধে! একবার বদন তুলে কথা কও |” সেই সময়ে বেহালাওয়ালা মৃদঙ্গীর হাতে তামাকের কল্কে দিয়া বলিতেছিল, “গুড়ুক খাও___” শুনিয়া মুচিরাম বলিল, “রাধে-একবার বদন তুলে-গুড়ক খাও |” হাসির চোটে যাত্রা ভাঙ্গিয়া গেল।
মুচিরাম প্রথমে বুঝিতে পারিল না-হাসি কিসের-যাত্রা ভাঙ্গিল কেন? কিন্তু যখন দেখিল, অধিকারী সাজঘরে আসিয়া একগাছা বাঁক সাপটিয়া ধরিয়া, তাহার দিকে ধাবমান হইলেন, তখন মুচিরাম হঠাৎ বুঝিল যে, এই বাঁক তাহার পৃষ্ঠদেশে অবতীর্ণ হইবার কিছু গুরুতর সম্ভাবনা-অতএব কথিত পৃষ্ঠদেশ স্থানান্তরে লইয়া যাওয়া আশু প্রয়োজন। এই ভাবিয়া মুচিরাম অকস্মাৎ নিষ্ক্রান্ত হইয়া নৈশ অন্ধকারে অন্তর্হিত হইল।
অধিকারী মহাশয় বাঁকহস্তে তৎপশ্চাৎ নিষ্ক্রান্ত হইয়া, তাহাকে না দেখিতে পাইয়া, তাহার ও তাহার পিতৃপিতামহ, মাতা ও ভগিনীর নানাবিধ অযশ কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। মুচিরামও এক বৃক্ষান্তরালে থাকিয়া অস্ফুটস্বরে অধিকারী মহাশয়ের পিতৃমাতৃ সম্বন্ধে তদ্রূপ অপবাদ রটনা করিতে লাগিল। অধিকারী মুচিরামের সন্ধান না পাইয়া, সাজঘরে গিয়া বেশ ত্যাগ করিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া শয়ন করিয়া রহিলেন। দেখিয়া মুচিরাম বৃক্ষচ্ছায়া ত্যাগ করিয়া, রুদ্ধদ্বারসমীপে দাঁড়াইয়া অধিকারীকে নানাবিধ অবক্তব্য কদর্য্য ভাষায় মনে মনে সম্বোধন করিতে লাগিল; এবং উভয় হস্তের অঙ্গুষ্ঠ উত্থিত করিয়া তাহাকে কদলীভোজনের অনুমতি করিল। তৎপরে রুদ্ধ কবাটকে বা কবাটের অন্তরালস্থিত অধিকারীর বদনচন্দ্রকে একটি লাথি দেখাইয়া, মুচিরাম ঠাকুরবাড়ীর মন্দিরের রোয়াকে গিয়া শয়ন করিয়া রহিল।
প্রভাতে উঠিয়া অধিকারী মহাশয় গ্রামান্তরে যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। শুনিলেন, মুচিরাম আইসে নাই-কেহ কেহ বলিল, তাহাকে খুঁজিয়া আনিব? অধিকারী মহাশয় গালি দিয়া বলিলেন, “জুট্তে হয়, আপনি জুট্বে, এখন আমি খুঁজে বেড়াতে পারি নে |” দয়ালুচিত্ত বেহালাওয়ালা বলিল, “ছেলেমানুষ-যদি নাই জুট্তে পারে-আমি খুঁজে আনিব।” অধিকারী ধমকাইলে-মনে মনে ইচ্ছা, মুচিরামের হাত হইতে উদ্ধার পান, এবং সেই সঙ্গে তাহার পাওনা টাকাগুলি ফাঁকি দেন। বেহালাওয়ালা ভাবিল-মুচিরাম কোনরূপে জুটিবে। আর কিছু বলিল না।
যাত্রার দল চলিয়া গেল-মুচিরাম জুটিল না। রাত্রিজাগরণ-দেবালয়বরণ্ডে সে অকাতরে নিদ্রা যাইতেছিল। উঠিয়া দল চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া, কাঁদিতে আরম্ভ করিল। এমন বুদ্ধি নাই যে, অধিকারী কোন্ পথে গিয়াছে, সন্ধান করিয়া সেই পথে যায়। কেবল কাঁদিতে লাগিল। পূজারি বামন অনুগ্রহ করিয়া বেলা তিন প্রহরে দুইটি ঠাকুরের প্রসাদ খাইতে দিল। খাইয়া, মুচিরাম কান্নার দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ করিল। যত রাত্রি নিকট হইতে লাগিল, তত ভাবিতে লাগিল-আমি কেন পালাইলাম! আমি কেন দাঁড়াইয়া মার খাইলাম না!
গ্রন্থকার ভনে, এবার যখন বাঁক উঠিতে দেখিবে, পিঠ পাতিয়া দিও। তোমার গোষ্ঠীর বাপচৌদ্দপুরুষ বুড়া সেনরাজার আমল হইতে কেবল পিঠ পাতিয়া দিয়াই আসিতেছে। তুমি পলাইবে কোথায়? এ সুসভ্য জগতের অধিকারীরা মুচিরাম দেখিলে বাঁকপেটাই করিয়া থাকে-মুচিরামেরা পিঠ পাতিয়াই দেয়। কেহ পালায় না-রাখাল ছাড়া কি গোরু থাকিতে পারে হে বাপু? ঘাস জলের প্রয়োজন হইলেই, তোমাদের যখন রাখাল ভিন্ন উপায় নাই, তখন পাঁচনবাড়িকে প্রাতঃপ্রণাম করিয়া গোজন্ম সার্থক কর!
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ঈশানবাবু একজন সৎকুলোদ্ভূত কায়স্থ। অতি ক্ষুদ্র লোক-কেন না, বেতন এক শত টাকা মাত্র-কোন জেলার ফৌজদারী আপিসের হেড কেরাণী। বাঙ্গালাদেশে মনুষ্যত্ব বেতনের ওজনে নির্ণীত হয়-কে কত বড় বাঁদর, তার লেজ মাপিয়া ঠিক করিতে হয়। এমন অধঃপতন আর কখন কোন দেশের হয় নাই। বন্দী চরণ-শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য দেখাইয়া বড়াই করে।
ঈশানবাবু ক্ষুদ্র ব্যক্তি-ল্যাজ খাটো, বানরত্নে খাটো-কিন্তু মনুষ্যত্বে নহে। যে গ্রামে হারাণ অধিকারী সেই অপূর্ব্ব মানভঞ্জন যাত্রা করিয়াছিলেন, ঈশানবাবুর সেই গ্রামে বাস। যাত্রাটা যে সময়ে হইয়াছিল, সে সময়ে তিনি ছুটি লইয়া বাড়ীতে ছিলেন। যাত্রার ব্যাপার তিনি কিছু জানিতেন কি না বলিতে পারি না। যাত্রার পরদিন সন্ধ্যাকালে তিনি পথে বেড়াইতেছিলেন, দেখিলেন, একটি ছেলে-শুষ্কশরীর, দীর্ঘকেশ-অনুভবে যাত্রার দলের ছেলে-পথে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে!
ঈশানবাবু ছেলেটির হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাঁদ্ছিস্ কেন বাবা?” ছেলে কথা কয় না। ঈশানবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
ছেলে বলিল, “আমি মুচিরাম |”
ঈশা। তুমি কাদের ছেলে?
মুচি। বামনদের।
ঈশা। কোন্ বামনদের?
মুচি। আমি গুড়েদের ছেলে।
ঈশা। তোমার বাড়ী কোথায়?
মুচি। আমাদের বাড়ী মোনাপাড়া।
ঈশা। সে কোথা?
তা ত মুচিরামের বিদ্যার মধ্যে নহে। যাই হৌক, ঈশানবাবু অল্প সময়ে মুচিরামের দুর্ঘটনা বুঝিয়া লইলেন। “তোমাকে বাড়ী পাঠাইয়া দিব” এই বলিয়া মুচিরামকে আপনার বাড়ী লইয়া গেলেন। মুচিরাম হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল। ঈশানবাবু তাহার আহারাদি ও অবস্থিতির উত্তম ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
কিন্তু মোনাপাড়ার ত কোন ঠিকানা হইল না। সুতরাং মুচিরাম ঈশানবাবুর গৃহে বাস করিতে লাগিল। সেখানে আহার পরিচ্ছদের ব্যবস্থা উত্তম, এবং কাণমলার অত্যন্তাভাব, দেখিয়া মুচিরাম বাড়ীর জন্য বিশেষ ব্যস্ত হইল না।
এদিকে ঈশানবাবুর ছুটি ফুরাইল-সপরিবারে কর্ম্মস্থানে যাইবেন। অগত্যা মুচিরামও সঙ্গে চলিল। কর্ম্মস্থানে গিয়াও ঈশান মোনাপাড়ার অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোন সন্ধান পাইলেন না। অগত্যা মুচিরাম তাঁহার গলায় পড়িল। মুচিরামও, সেখানে আহারের ব্যবস্থা উত্তম, সেখানে গলায় পড়িতে নারাজ নহে-তবে ঈশানবাবুর একটা ব্যবস্থা মুচিরামের বড় ভাল লাগিল না। ঈশানবাবু বলিলেন, “বাপু, যদি গলায় পড়িলে, তবে একটু লেখা পড়া শিখিতে হইবে |” ঈশানবাবু তাহাকে পাঠশালায় পাঠাইয়া দিলেন।
এখানে মুচিরামের মা অনেক দিন হইতে ছেলের কোন সম্বাদ না পাইয়া, পাড়ায় পাড়ায় বিস্তর কাঁদাকাটি করিয়া বেড়াইয়া, শেষ আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিল। আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া রুগ্ন হইল। রুগ্ন হইয়া মরিয়া গেল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এদিকে, যশোদানন্দন, শ্রীশ্রীমুচিরাম শর্ম্মা-ঈশানমন্দিরে সুবিরাজমান-সম্পূর্ণরূপে মাতৃবিস্মৃত। যদি কখন মাকে মনে পড়িত, তবে সে আহারের সময়-ঈশানবাবুর ঘরের প্রফুল্ল-মল্লিকাসন্নিভ সিদ্ধান্ন, দানাদার গব্য ঘৃত, সুগন্ধি ঝোলে নিমগ্ন রোহিতমৎস্য, পৃথিবীর ন্যায় নিটোল গোলাকার সদ্যভর্জ্জিত লুচির রাশি-এই সকল পাতে পাইলে মুচিরাম মনে করিতেন, “মা বেটী কি ছাই-ই আমাকে খাওয়াইত!” সে সময়ে মাকে মনে পড়িত-অন্য সময়ে নহে।
মুচিরামের পাঠশালার লেখা পড়া সমাপ্ত হইল-অর্থাৎ গুরু মহাশয় বলিল, সমাপ্ত হইয়াছে। মুচিরামের কোন গুণ ছিল না, এমত বলি না; তাহা হইলে এ ইতিহাস লিখিতে আমি প্রবৃত্ত হইতাম না। মুচিরামের কণ্ঠস্বর ভাল ছিল বলিয়াছি-গুণ নম্বর এক। গুণ নম্বর দুই, তাহার হস্তাক্ষর অতি সুন্দর হইল। আর কিছু হইল না। ঈশানবাবু মুচিরামকে ইংরেজি স্কুলে পাঠাইলেন।
মুচিরাম ধেড়ে ছেলে, স্কুলে ঢুকিয়া বড় বিপদ্গ্রস্ত হইল। মাষ্টারেরা তামাসা করে, ছোট ছোট ছেলেরা খিল্খিল্ করিয়া হাসে। মুচিরাম রাগ করে, কিন্তু পড়ে না। সুতরাং মাষ্টারেরা হারাণ অধিকারীর পথে গেলেন। আবার কাণমলায় কাণমলায় মুচিরামের কাণ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। প্রথমে কাণমলা, তার পর বেত্রাঘাত, মুষ্ট্যাঘাত, চপেটাঘাত, কীলাঘাত, এবং ঘুসাঘাত। ঈশানবাবুর ঘরের তপ্ত লুচির জোরে মুচিরাম নির্ব্বিবাদে সব হজম করিল।
এইরূপে মুচিরাম, তপ্ত লুচি ও বেত খাইয়া, স্কুলে পাঁচ-সাত বৎসর কাটাইল। কিছু হইল না। ঈশানবাবু তাহাকে স্কুল হইতে ছাড়াইয়া লইলেন। ঈশানবাবুর দয়ার শেষ নাই-মাজিষ্ট্রেট সাহেবের কাছে তাঁহার বিশেষ প্রতিপত্তি-মুচিরামের হাতের লেখাও ভাল-ঈশানবাবু মুচিরামের একটি দশ টাকার মুহুরিগিরি করিয়া দিলেন। বলিয়া দিলেন, “ঘুস ঘাস লইও না বাপু, তা হলে তাড়াইয়া দিব।” মুচিরাম শর্ম্মা প্রথম দিনেই একটা হুকুমের চোরাও নকল দিয়া আট গণ্ডা পয়সা হাত করিলেন, এবং সন্ধ্যার অল্পকাল পরেই তাহা প্রতিবাসিনীবিশেষের পাদপদ্মে উৎসর্গ করিলেন।
এদিকে ঈশানবাবুও প্রাচীন হইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি ইহার পরেই পেন্সন লইয়া স্বকর্ম্ম হইতে অবসৃত হইলেন এবং মুচিরামকে পৃথক্ বাসা করিয়া দিয়া, সপরিবারে স্বদেশে প্রস্থান করিলেন। মুচিরাম ঈশানবাবুকে একটু ভয় করিত-এক্ষণে তাহার পোয়া বারো পড়িয়া গেল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পোয়া বারো-মুচিরাম জেলা লুঠিতে লাগিল। প্রথম লোকের কাছে চাহিয়া চিন্তিয়া দুই চারি আনা লইত। তার পর দাঁও শিথিল। ফেলু সেখের ধানগুলি জমীদার জোর করিয়া কাটিয়া লইতে উদ্যত, সাহেব দয়া করিয়া পুলিশকে হুকুম দিলেন, ফেলুর সম্পত্তি রক্ষা করিবে। সাহেব হুকুম দিলেন, কিন্তু পুলিশের নামে পরওয়ানাখানি লেখা আর হয় না। পরওয়ানা লেখা মুচিরামের হাত। পরওয়ানা যাইতে যাইতে ধান থাকে না; ফেলু মুচিরামকে এক টাকা, দুই টাকা, তিন টাকা, ক্রমে পাঁচ টাকা স্বীকার করিল-তৎক্ষণাৎ পরওয়ানা বাহির হইল। তখন মাজিষ্ট্রেটেরা স্বহস্তে জোবানবন্দী লইতেন না-এক কোণে বসিয়া এক একজন মুহুরি ফিস্ফিস্ করিয়া জিজ্ঞাসা করিত, আর যাহা ইচ্ছা তাহা লিখিত। সাক্ষীরা এক রকম বলিত, মুচিরাম আর এক রকম জোবানবন্দী লিখিতেন, মোকদ্দমা বুঝিয়া ফি সাক্ষ্য-প্রতি চারি আনা, আট আনা, এক টাকা পাইতেন। মোকদ্দমা বুঝিয়া মুচি দাঁও মারিতেন; অধিক টাকা পাইলে সব উল্টা লিখিতেন। এইরূপে নানাপ্রকার ফিকির ফন্দীতে মুচিরাম অনেক টাকা উপার্জ্জন করিতে লাগিলেন-তিনি একা নহেন, সকলেই করিত-তবে মুচি কিছু অধিক নির্লজ্জ-কখন কখন লোকের টেঁক হইতে টাকা কাড়িয়া লইত।
যাই হৌক, মুচি শীঘ্রই বড়মানুষ হইয়া উঠিল-কোন্ মুচি না হয়?-অচিরাৎ সেই অকৃতনাম্নী প্রতিবাসিনী স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা হইল। মদ, গাঁজা, গুলি, চরস, আফিঙ্গ-যাহার নাম করতে আছে এবং যাহার নাম করিতে নাই-সকলই মুচিবাবুর গৃহকে অহর্নিশি আলোক ও ধূমময় করিতে লাগিল। মুচিরামেরও চেহারা ফিরিতে লাগিল-গালে মাস লাগিল-হাড় ঢাকিয়া আসিল-বর্ণ জাপান লেদার ছাড়িয়া দিল্লীর নাগরায় পৌঁছিল। পরিচ্ছদের বৈচিত্র্য জন্মিতে লাগিল-শাদা, কালো, নীল, জরদা, রাঙ্গা, গোলাপী প্রভৃতি নানা বর্ণের বস্ত্রে মুচিরাম সর্ব্বদা রঞ্জিত। রাত্রি দিন মাথায় তেড়ি কাটা, অধরে তাম্বূলের রাগ এবং কণ্ঠে নিধুর টপ্পা। সুতরাং মুচিরামের পোয়া বারো।
দোষের মধ্যে সাহেব বড় খিট্খিট্ করে। মুচিরাম একে ঘোরতর বোকা, কোন কর্ম্মই ভাল করিয়া করিতে পারিত না, তাহাতে আবার দুর্জ্জয় লোভ,-সকল-তাতে মুচিরাম গালি খাইত। সাহেবটাও বড় বদরাগী-অনেক সময়ে মুচিরামকে কাগজপত্র ছুঁড়িয়া মারিত। সাহেবের ভিতরে ভিতরে হৃদয়ে দয়া ছিল-নচেৎ মুচিরামের চাকরী অধিক কাল টিকিত না।
সৌভাগ্যক্রমে সে সাহেব বদলি হইয়া গেল-আর একজন আসিল।
এই নূতন সাহেবটির নাম (Grongerham) লিখিবার সময়ে লোকে লিখিত গ্রঙ্গারহ্যাম-বলিবার সময়ে বলিত গঙ্গারাম সাহেব। গঙ্গরাম সাহেব অতি ভদ্রলোক, দয়ার সাগর, কাহারও কোন অনিষ্ট করিতেন না, মোকদ্দমা করিতে গিয়া, কেবল ডিষমিস করিতেন। তবে সাহেব কিছু অলস, কাজ কর্ম্মে বড় মন দিতেন না, এবং নিজে সরল বলিয়া তাঁবেদারদিগের উপর বড় বিশ্বাস ছিল। সকল কর্ম্মের ভার সেরেস্তাদার এবং হেড কেরাণীর উপর ছিল। যত দিন সাহেব ঐ জেলায় ছিলেন, একদিনের জন্য একখানি চিঠি স্বহস্তে মুশাবিদা করেন নাই-হেড কেরাণী সব করিত।
সাহেব প্রথম আসিয়া, মুচিরামের কালোকালো নধর সুচিক্কণ শরীরটি দেখিয়া, এবং তাহার আভূমিপ্রণত ডবল সেলাম দেখিয়া নিজের সরলচিত্তে একেবারে সিদ্ধান্ত করিলেন যে, আপিসের মধ্যে এই সর্ব্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক। সে বিশ্বাস তাঁহার কিছুতেই গেল না। যাইবারও কোন কারণ ছিল না–কেন না, কাজকর্ম্মের তিনি খবর রাখিতেন না। একদিন আপিসের মীর মুন্সী মিরজা গোলাম সর্ফদর খাঁ সাহেব, দুনিয়াদারি নামাফিক মনে করিয়া ফৌত করিলেন। সাহেব পরদিনেই মুচিরামকে ডাকিয়া তৎপদে অভিষিক্ত করিলেন। মীর মুন্সীর বেতন কুড়ি টাকা-কিন্তু বেতনে কি করে? পদটি রুধিরে পরিপ্লুত। অজরামরবৎপ্রাজ্ঞ মুচিরাম শর্ম্মা রুধিরসঞ্চয় করিতে লাগিলেন।
দোষ কি? অজরামরবৎপ্রাজ্ঞ বিদ্যামর্থঞ্চ চিন্তয়েৎ। দুইটা একজনে পারে না-মুচিরাম বিদ্যাচিন্তা করিতে সক্ষম নহেন; কোষ্ঠীতে তাহা লেখে নাই-অতএব
বিষ্ণুশর্ম্মার উপদেশানুসারে মৃত্যুভয় রহিত হইয়া তিনি অর্থচিন্তায় প্রবৃত্ত। যদি সেই “হিতোপদেশ”গুলি অধীত হইবার যোগ্য হয়-যদি সে গ্রন্থ এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও পূজার যোগ্য হয়-তবে মুচিরামও প্রাজ্ঞ-আর এ দেশের সকল মুচিই প্রাজ্ঞ।
বিষ্ণুশর্ম্মা ভারতবর্ষের মাকিয়াবেল্লি-চাণক্য ভারতের রোশফুকল। যাহার এইরূপ গ্রন্থ বিদ্যালয়ের বালকদিগকে পড়াইবার নিয়ম করিয়াছে, তাহাদিগের উচিত, আবার বিদ্যালয়ের প্রবেশ করা। তাহাদের শিক্ষা হয় নাই।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
মুচিরাম দুই তিন বৎসর মীর মুন্সীগিরি করিল-তার পর কালেক্টরীর পেস্কারি খালি হইল। পেস্কারিতে বেতন পঞ্চাশ টাকা-আর উপার্জ্জনের ত কথাই নাই। মুচিরাম ভাবিল, কপাল ঠুকিয়া একখানা দরখাস্ত করিব।
তখন কালেক্টর ও ম্যাজিষ্ট্রেট পৃথক্ পৃথক্ ব্যক্তি হইত। সেখানে সে সময়ে হোম নামা এক সাহেব কালেক্টর ছিলেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান্ ও কর্ম্মঠ লোক ছিলেন, কিন্তু একটা দোষ ছিল-কিছু মিষ্ট কথার বশ।
মুচিরাম একখানি ইংরেজি দরখাস্ত লিখাইয়া লইল-মুচিরামের নিজবিদ্যা দরখাস্ত পর্য্যন্ত কুলায় না। যে দরখাস্ত লিখিল, মুচিরাম তাহাকে বলিয়া দিলেন, “দেখিও যেন ভাল ইংরেজি না হয়। আর যা হৌক না হৌক, দরখাস্তের ভিতর যেন গোটা কুড়ি ‘মাই লার্ড’ আর ‘ইওর লার্ডশিপ’ থাকে |” লিপিকার সেই রকম দরখাস্ত লিখিয়া দিল। তখন শ্রীমুচিরাম বেশভূষায় প্রবৃত্ত হইলেন। আপনার চারখানির ঢিলা পায়জামা পরিত্যাগ করিয়া, থানের ধুতি শ্রীঅঙ্গে পরিধান করিলেন; চুড়িদার আস্তীন আল্পাকার চাপকান পরিত্যাগ করিয়া, পূর্ব্বক, বুকফাঁক বন্ধকওয়ালা ঢিলা আস্তীন লাংক্লথের চাপকান গ্রহণ করিলেন। লাটুদার পাগড়ি ফেলিয়া দিয়া, স্বহস্তে মাথায় বিড়া জড়াইলেন; এবং চাঁদনির আম্দানি নূতন চক্চকে জুতা ত্যাগ করিয়া চটিতে চারুচরণদ্বয় মণ্ডন করিলেন। ইতিপূর্ব্বে গঙ্গারাম সাহেবকে হরিয়েক রকম সেলাম করিয়া, কাঁদো কাঁদো মুখ করিয়া, একখানা সুপারিস চিঠি বাহির করিয়া লইয়াছিলেন। এইরূপ চিঠি, দরখাস্ত ও বিহিত সজ্জাসহিত সেই শ্রীমুচিরামচন্দ্র, যথায় হোম সাহেব এজলাসে বসিয়া দুনিয়া জলুস করিতেছিলেন, তথায় গিয়া দর্শন দিলেন।
রেল দেওয়া কাটরার ভিতর, উঁচুতে হোম সাহেব এজলাস করিতেছেন। চারি দিকে অনেক মাথায় পাগড়ি ঙ বসিয়াছে-লোকে কথা কহিলেই চাপরাশী বাবাজিউরা দাড়ি ঘুরাইয়া গালি দিতেছেন-একটা স্পানিয়েল টেবিলের নীচে শুইয়া, অর্থিগণের নয়নপথে লাঙ্গুল-শোভা বিকাশ করিতেছে-এক ফোঁটা গুড় পড়িলে যেমন সহস্র সহস্র পিপীলিকা তাহা বেষ্টন করে, খালি চাকরীটির মালিক হোম সাহেবকে তেমনি উমেদওয়ার ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাহেব উমেদওয়ারদিগের দরখাস্ত শুনিতেছেন। অনেক বড় বড় ইংরেজিনবীশ আসিয়াছেন-সেকেলে কেঁদো কেঁদো স্কলার্শিপ হোল্ডার। সাহেব তাঁহাদিগকে এক এক কথায় বিদায় করিলেন। “I dare say you are well up in Shakespeare and Milton and Bacon and so forth. Unfortunately we don’t want quotations from Shakespeare and Milton and Bacon in the office. It is not the most learned man who is best fitted for this kind of work. So you can go, Baboo.” অনেক শামলা মাথায় দিয়া, চেন ঝুলাইয়া, পরিপাটী বেশ করিয়া আসিয়াছিলেন, সাহেব দৃষ্টিমাত্র তাঁহাদিগকে বিদায় দিলেন। “You are very rich I see; I want a poor man who will work for his bread. You will throw up your place on the slightest quarrel. You can go.” শামলা চেনের দল, অভিমন্যুসম্মুখে কুরুসৈন্যের ন্যায় বিমুখ হইতে লাগিল। বাকি রহিল মুচিরাম, এবং তাহার সমকক্ষজনকয়-বানর। সাহেব মুচিরামের দরখাস্ত পড়িলেন-হাসিয়া বলিলেন, “Why do you call me, my Lord? I am not a Lord.”
মুচিরাম যোড়হাতে হিন্দীতে বলিল, “বান্দা কো মালুম থা কি হুজুর লার্ড- ঘরানা |”
এখন হোম সাহেবের সঙ্গে একটা লার্ড হোমের দূরসম্বন্ধ ছিল। সেই জন্য তাঁহার মনে বংশমর্য্যাদা সর্ব্বদা জাগরূক ছিল; মুচিরামের উত্তর শুনিয়া আবার হাসিয়া বলিলেন, “হো সকতা; লার্ড ঘরানা হো সকতা; লার্ড ঘরানা হোনে সে হি লার্ড হোতা নেহি |”
সকলেই বুঝিল যে, মুচিরাম কার্য্য সিদ্ধ করিয়াছে। মুচিরাম যোড়হাতে প্রত্যুত্তর করিল, “বান্দা লোক কে ওয়াস্তে হুজুর লার্ড হেঁয় |”
সাহেব মুচিরামকে আর দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া তাহাকে পেস্কারিতে বহাল করিলেন।
Struggle for existence? Survival of the Fittest! মুচির দলই এ পৃথিবীতে চিরজয়ী।
হোম সাহবের কিছু মাত্র দোষ নাই। দেশী, বিদেশী, সকল মনুষ্যই এইরূপ। সকলেই মিষ্ট কথার বশ। অবোধ বাঙ্গালীরা আজকাল মিষ্ট কথা ভুলিতেছে। হোম সাহেব একজন অতিশয় সুদক্ষ, সুবিজ্ঞ লোক। মূর্খ মুচিরামও তাঁহাকে ভুলাইতে পারিল-কেবল মিষ্ট কথার বলে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
মুচিরামবাবু-এখন তিনি একটা ভারি রকম বাবু, এখন তাঁহাকে শুধু মুচিরাম বলা যাইতে পারে না-মুচিরামবাবু পেস্কারি পাইয়া বড় ফাঁফরে পড়িলেন। বিদ্যাবুদ্ধিতে পেস্কারি পর্য্যন্ত কুলায় না-কাজ চলে কি প্রকারে? “ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়”-মুচিরামবাবুর বোঝা বাহিত হইল। ভজগোবিন্দ চক্রবর্ত্তী নামে একজন তাইদনবীশ সেই কালেক্টরী আপিসে থাকে। ভজগোবিন্দ বার বৎসর তাইদনবীশ আছে। সে বুদ্ধিমান্, কর্ম্ঠ, কালেক্টরীর সকল কর্ম্ম কাজ বার বৎসর ধরিয়া শিখিয়াছে। কিন্তু মুরুব্বি নাই-ভাগ্য নাই-এ পর্য্যন্ত কিছু হয় নাই। তাহার বাসাখরচ চলে না। মুচিরাম তাহাকে অবলম্বন করিলেন। আপনার বাসায় লইয়া গিয়া রাখিলেন। ভজগোবিন্দ মুচিরামের বাসায় থাকে, খায় পরে, গৃহকর্ম্মের সহায়তা করে, রাত্রিকালে বাবুর ঘরে বাহিরে মোসাহেবী করে, এবং আপিসের সমস্ত কাজ কর্ম্ম করিয়া দেয়। মুচিরাম তাহাকে টাকাটা সিকেটা দেওয়াইয়া দেন। ভজগোবিন্দের সাহায্যে মুচিরামের কর্ম্ম কাজ রেলগাড়ির মত গড় গড় করিয়া চলিল। হোম সাহেব অনেক প্রশংসা করিতেন। বিশেষ মুচিরাম বিশুদ্ধ প্রণালীতে সেলাম করিত, এবং “মাই লর্ড” এবং “ইওর আনর” কিছুতেই ছাড়িত না।
মুচিরামবাবুর উপার্জ্জনের আর সীমা রহিল না। হাতে অনেক টাকা জমিয়া গেল। ভজগোবিন্দ বলিল, “টাকা ফেলিয়া রাখিবার প্রয়োজন নাই-তালুক মুলুক করুন |” মুচিরাম সম্মত হইলেন, কিন্তু যে যে জেলায় কর্ম্ম করে, সে জেলায় বিষয় খরিদ করা নিষেধ। ভজগোবিন্দ বলিল যে, বেনামীতে কিনুন। কাহার বেনামীতে? ভজগোবিন্দের ইচ্ছা, ভজগোবিন্দের নামেই বিষয় খরিদ হয়, কিন্তু সাহস করিয়া বলিতে পারিল না। এ দিকে মুচিরাম কাহারও বাসায় গল্প শুনিয়া আসিলেন যে, স্ত্রীর অপেক্ষা আত্মীয় কেহ নাই। কথাটায় তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল কি না জানি না-কিন্তু মনে মনে ভাবিলেন যে, স্ত্রীর নামে বিষয় করাই বেনামীর শ্রেষ্ঠ। এই এখনকার দেবত্র। আগে লোকে বিষয় করিত ঠাকুরের নামে-এখন বিষয় করিতে হয় ঠাকুরুণের নামে। উভয় স্থলেই বিষয়কর্ত্তা “সেবাইত” মাত্র-পরম-ভক্ত-পাদপদ্মে বিক্রীত। এইরূপ রাধাকান্ত জিউর স্থানে রাধামণি, শ্যামসুন্দরের স্থানে শ্যামসুন্দরী দেবী মালিক হওয়া ভাল হইয়াছে, কি মন্দ হইয়াছে, জানি না-তবে একটা কথা বুঝা যায়। বিষয় হস্তান্তরের কিছু সুবিধা হইয়াছে। দধি ভোজনের পক্ষে নেপোর খুব সুযোগ হইয়াছে।
স্ত্রীর বেনামীতে বিষয় করা শ্রেয়ঃ, ইহা মুচিরাম বুঝিলেন, কিন্তু এই সঙ্কল্পে একটা সামান্য রকম বিঘ্ন উপস্থিত হইল-মুচিরামের স্ত্রী নাই। এ পর্য্যন্ত তাঁহার বিবাহ করা হয় নাই-অনুকল্পের অভাব ছিল না। কিন্তু এ স্থলে অনুকল্প চলিবে কি না, তদ্বিষয়ে পেস্কার মহাশয় কিছু সন্দিহান হইলেন। ভজগোবিন্দের সঙ্গে কিছু বিচার হইল–কিন্তু ভজগোবিন্দ একপ্রকার বুঝাইয়া দিল যে এ স্থলে অনুকল্প চলিবে না। অতএব মুচিরাম দারগ্রহণে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। কোন্ কুল পবিত্র করিবেন, তাহার অন্বেষণ করিতেছিলেন, এমন সময় ভজগোবিন্দ জানাইল যে, তাহার একটি অবিবাহিতা ভগিনী আছে-ভজগোবিন্দের পিতৃকূল উজ্জ্বল করায় ক্ষতি নাই। অতএব মুচিরাম একদিন সন্ধ্যার পর শুভ লগ্নে মাথার টোপর দিয়া, হাতে সুতা বাঁধিয়া, এবং পট্টবস্ত্র পরিধান করিয়া ভদ্রকালী নাম্নী ভজগোবিন্দের সহোদরাকে সৌভাগ্যশালিনী করিলেন। তাহার পর হইতে ভদ্রকালীর নামে অনেক জমিদারী পত্তনি ছলে, বলে, কলে, কৌশলে খরিদ হইতে লাগিল। ভদ্রকালী হঠাৎ জেলার মধ্যে একজন প্রধানা ভূম্যধিকারিণী হইয়া দাঁড়াইলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
ভদ্রকালীর দ্বাদশ বৎসর বয়সে বিবাহ হয়-মুচিরামের এমনই অদৃষ্ট-বিবাহের পর দুই বৎসরের মধ্যে, ভদ্রকালী চৌদ্দ বৎসরের হইল। চৌদ্দ বৎসরের হইয়াই ভদ্রকালী ভজগোবিন্দের একটি চাকরির জন্য মুচিরামের উপর দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল, সুতরাং মুচিরাম চেষ্টা চরিত্র করিয়া ভজগোবিন্দের একটি মুহুরিগিরি করিয়া দিলেন।
ইহাতে মুচিরাম কিছু বিপন্ন হইলেন। এক্ষণে ভজগোবিন্দের নিজের কাজ হইল-সে মনোযোগ দিয়া নিজের কাজ করে; মুচিরামের কাজ করিয়া দিবার তাহার তত অবকাশ থাকে না। ভজগোবিন্দ সুপাত্র-শীঘ্রই হোম সাহেবের প্রিয়পাত্র হইল। মুচিরামের কাজের যে সকল ত্রুটি হইতে লাগিল, হোম সাহেব তাহা দেখিয়াও দেখিতেন না। আভূমিপ্রণত সেলাম এবং মাই লার্ড বুলির গুণে সে সকলের প্রতি অন্ধ হইয়া রহিলেন। মুচিরামের প্রতি তাঁহার দয়া অচলা রহিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ সময়ে হোম সাহেব বদলি হইয়া গেলেন, তাঁহার স্থানে রীড সাহেব আসিলেন। রীড অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি। অতি অল্প দিনেই বুঝিলেন-মুচিরাম একটি বৃক্ষভ্রষ্ট বানর-অকর্ম্মা অথচ ভারি রকমের ঘুষখোর। মুচিরামকে আপিস হইতে বহিষ্কৃত করা মনে স্থির করিলেন। কিন্তু রীড সাহেব যেমন বিচক্ষণ, তেমনি দয়াশীল ও ন্যায়বান্; সে কালের হেলীবরির সিবিলিয়ান সাহেবরা বাঙ্গালীদিগকে পুত্রের মত স্নেহ করিতেন। মিছে ছুতাছলে কাহাকে অন্নহীন করিতে রীড সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছুক ; কাহাকে একেবারে অন্নহীন করিতে অনিচ্ছুক। মুচিরাম যে বিপুল ভূসম্পত্তি করিয়াছে-রীড সাহেব তাহা জানিতে পারেন নাই। রীড সাহেব মুচিরামকে দুই একবার ইস্তেফা দিতে বলিয়াছিলেন বটে, কিন্তু মুচিরাম চোখে জল আনিয়া দুই চারি বার “গরীব খানা বেগর মারা যায়েগা” বলাতে তিনি নিরস্ত হইয়াছিলেন। তারপর, তাহাকে পেস্কারির তুল্য বেতনে আবকারির দারোগাই দিতে চাহিয়াছিলেন-অন্যান্য মফস্বলি চাকরি করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন-কিন্তু আবার মুচিরাম চোখে জল আনিয়া বলে যে, আমার শরীর ভাল নহে, মফস্বলে গেলে মরিয়া যাইব-হুজুরের চরণের নিকট থাকিতে চাই। সুতরাং দয়ালুচিত্ত রীড সাহেব নিরস্ত হইলেন। কিন্তু তাহাকে লইয়া আর কাজও চলে না। অগত্যা রীড সাহেব মুচিরামকে ডিপুটি কালেক্টর করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টে রিপোর্ট করিলেন। সেই সময়ে হোম সাহেব বাঙ্গাল আপিসে সেক্রেটরি ছিলেন-রিপোর্ট পৌঁছিবামাত্র মুচিরাম ডিপুটি বাহাদুরিতে নিযুক্ত হইলেন।
রীড সাহেব-ইহাতে বিজ্ঞ লোকের মতই কাজ করিয়াছিলেন। তিনি বিলক্ষণ জানিতেন যে, ভারি ঘুষখোরেও ডিপুটি হইলেই ঘুষ খাওয়া ত্যাগ করে; ডিপুটিগিরি এক প্রকারে আমলাদিগের বৈধব্য-বিধবা হইলে আর মাছ খাইতে নাই। আর মুচিরাম যে মূর্খ, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না; সেরূপ অনেক ডিপুটি আছে; ডিপুটিগিরিতে বিদ্যাবুদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা যায় না। অতএব রীড সাহেব লোকহিতার্থ মুচিরামকে ডিপুটি করিবার জন্য রিপোর্ট করিয়াছিলেন।
আপিসে সম্বাদ পৌঁছিল যে, মুচিরামের উচ্চ পদ হইয়াছে। একজন বুড়া মুহুরি ছিল, সে বড় সাধুভাষা বুঝিত না। “উচ্চ পদ” শুনিয়া সে বলিল, “কি? ঠ্যাঙ্গ উঁচু করেছেন না কি? ভাগাড়ে দিয়া আইবা |”
দশম পরিচ্ছেদ
মুচিরামের মাথায় বজ্রাঘাত হইল। তিনি পেস্কারিতে ঘুষ লইয়া অসংখ্য টাকা রোজগার করেন-আড়াই শত টাকার ডিপুটিগিরিতে তাঁহার কি হইবে? মুচিরাম সিদ্ধান্ত করিলেন-ডিপুটিগিরি অস্বীকার করিবেন। কিন্তু ভজগোবিন্দ বুঝাইলেন যে, অস্বীকার করিলে রীড সাহেব নিশ্চয় বুঝিবে যে, মুচিরাম ঘুষের লোভে পেস্কারি ছাড়িতেছে না-তাহা হইলে শীঘ্রই তাড়াইয়া দিবে। তখন দুই দিক যাইবে। অগত্যা মুচিরাম ডিপুটিগিরি স্বীকার করিলেন।
মুচিরাম ডিপুটি হইয়া প্রথম রূবকারী দস্তখতকালীন পড়িয়া দেখিলেন, লেখা আছে, শ্রীযুক্ত বাবু মুচিরাম গুড় রায়বাহাদুর ডিপুটি কালেক্টর। প্রথমটা বড়ই আহ্লাদ হইল,-কিন্তু শেষ কিছু লজ্জাবোধ হইতে লাগিল। যে মুহুরি রূবকারী লিখিয়াছিল, তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওহে-গুড়টা নাই লিখিলে। শুধু মুচিরাম রায়বাহাদুর লেখায় ক্ষতি কি? কি জান, আমরা গুড় বটে, কিন্তু আমাদের খেতাব রায়। তবে যখন অবস্থা তেমন ছিল না, তখন রায় খেতাব আমরা লিখিতাম না। তা’ এখন গুড়েও কাজ নাই, শুধু মুচিরাম রায়বাহাদুর লিখিলেই হইবে |” মুহুরি ইঙ্গিত বুঝিল, হাকিমের মন সবাই রাখিতে চায়। সে মুহুরি দ্বিতীয় রূবকারীতে লিখিল, “বাবু মুচিরাম রায়, রায়বাহাদুর |” মুচিরাম দেখিয়া কিছু বলিলেন না, দস্তখত করিয়া দিলেন। সেই অবধি মুচিরাম “রায়” চলিতে লাগিল; কেহ লিখিত, “মুচিরাম রায়, রায়বাহাদুর,” কেহ লিখিত, “রায় মুচিরাম রায় বাহাদুর |” মুচিরামের একটা যন্ত্রণা ঘুচিল-গুড় পদবীতে তিনি বড় নারাজ ছিলেন, এখন সে জ্বালা গেল। তবে লোকে অসাক্ষাতে বলিত “গুড়ের পো”-অথবা “গুড়ে ডিপুটি |” আর স্কুলের ছেলেরা কবিতা করিয়া শুনাইয়া শুনাইয়া বলিত,
“গুড়ের কল্সীতে ডুবিয়ে হাত
বুঝতে নারি সার কি মাত?”
কেহ বলিত,
“সরা মাল্সায় খুসি নই।
ও গুড় তোর নাগরী কই?”
মুচিরাম তাহাদের তাড়াইয়া মারিতে গেলেন, তাহারা তাঁহাকে মুখ ভেঙ্গাইয়া, উভয় হস্তের অঙ্গুষ্ঠ সন্দর্শন করাইয়া, উচ্চৈঃস্বরে কবিতা আওড়াইতে আওড়াইতে পলাইল। লাভের মধ্যে মুচিরাম লম্বা কোঁচা বাঁধিয়া আছাড় খাইলেন-ছেলেদের আনন্দের সীমা থাকিল না। শেষে মুচিরাম স্কুলের ছেলেদের মাসে মাসে কিছু সন্দেশ বরাদ্দ করিয়া দিয়া কবিতা হইতে উদ্ধার পাইলেন। কিন্তু আর একটা নূতন গোল হইল। শীতকালে খেজুর গুড়ের সন্দেশ উঠিল-ময়রারা তাহার নাম দিল ডিপুটি মণ্ডা।
বাজারে যাহা হউক, সাহেবমহলে মুচিরামের বড় সুখ্যাতি হইল। বৎসর বৎসর রিপোর্ট হইতে লাগিল, এরূপ সুযোগ্য ডিপুটি আর নাই। এরূপ সুখ্যাতির কারণ-
প্রথম। সেই মিষ্ট কথা। একবার তিনি কমিশনার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। সাহেব তখন মেমসাহেবের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া গরমমেজাজ ছিলেন, এতেলা হইবামাত্র বলিলেন, “নেকাল দেও শালাকো |” বাহির হইতে মুচিরাম শুনিতে পাইয়া সেইখান হইতে দুই হাতে সেলাম করিয়া বলিল, “বহুৎ খুব হুজুর। হামারা বহিনকো খোদা জিতা রাখে |”
দ্বিতীয়। মুচিরাম ডিপুটির হাতে প্রায় হপ্তম পঞ্জমের কাজ ছিল-অন্য কাজ বড় ছিল না। হপ্তম পঞ্জমের মোকদ্দমায় একে সহজেই বড় বিচার আচারের প্রয়োজন হইত না-তাতে আবার মুচিরাম বিচার আচারের বড় ধার ধারিতেন না-চোখ বুজিয়া ডিক্রী দিতেন-নথির কাগজও বড় পড়িতেন না। সুতরাং মাস্কাবার দেখিয়া সাহেবরা ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। জনরব যে, মুচিরামের একেবারে হঠাৎ সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীতে পদবৃদ্ধি হইবে। কতকগুলো চেঙ্গড়া ছোঁড়া শুনিয়া বলিল, “আরও পদবৃদ্ধি? ছটা পা হবে না কি?”
দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সময়ে চট্টগ্রামের কালেক্টরীতে কিছু গোলযোগ উপস্থিত হইল। গোল মিটাইবার জন্য সেখানকার কমিশ্যনার একজন ভারি বিচক্ষণ ডিপুটি কালেক্টর পাইবার প্রার্থনা করিলেন। বোর্ড বলিলেন-বিচক্ষণ ডিপুটি? সে ত মুচিরাম ভিন্ন আর কাহাকে দেখি না-তাহাকেই চট্টগ্রাম পাঠান হৌক। গবর্ণমেণ্ট সেই কথা মঞ্জুর করিয়া মুচিরামকে চাটিগাঁ বদলি করিলেন।
সম্বাদ পাইয়া মুচিরাম বলিলেন, এইবার চাকরি ছাড়িতে হইল। তাঁহার শোনা ছিল, চাটিগাঁ গেলেই লোকে জ্বর প্লীহা হইয়া মরিয়া যায়। আরও শোনা ছিল যে, চাটিগাঁ যাইতে সমুদ্র পার হইতে হয়-এক দিন এক রাত্রের পাড়ি। সুতরাং চাটিগাঁ যাওয়া কি প্রকারে হইতে পারে? বিশেষ ভদ্রকালী-ভদ্রকালী এখন পূর্ণযৌবনা-সে বলিল, “আমি কোন মতেই চাটিগাঁ যাইব না-কি তোমায় যাইতে দিব না। তুমি যদি যাও, তবে আমি বিষ খাইব |” এই বলিয়া ভদ্রকালী একটা বড় খোরা লইয়া তেঁতুল গুলিতে বসিলেন। ভদ্রকালী তেঁতুল ভালবাসিতেন-মুচিরাম বলিতেন, “ওতে ভারি অম্বল হয়-ও বিষ |” তাই ভদ্রকালী তেঁতুল গুলিতে বসিলেন-মুচিরাম হাঁ হাঁ করিয়া নিষেধ করিতে লাগিলেন-ভদ্রকালী তাহা না শুনিয়া “বিষ খাইব” বলিয়া সেই তেঁতুলগোলায় লবণ ও শর্করা সংযোগপূর্ব্বক আধ সের চাউলের অন্ন মাখিয়া লইলেন। মুচিরাম অশ্রুপূর্ণলোচনে শপথ করিলেন যে, তিনি কখনই চাটিগাঁ যাইবেন না। ভদ্রকালী কিছুতেই শুনিল না-সমুদায় তেঁতুলমাখা ভাতগুলি খাইয়া বিষপান-কার্য্য সমাধা করিল। মুচিরাম তৎক্ষণাৎ চাকরিতে ইস্তেফা পাঠাইয়া দিলেন।
স্থূল কথা, মুচিরামের জমীদারীর আয় এত বৃদ্ধি হইয়াছিল যে, ডিপুটিগিরির সামান্য বেতন, তাঁহার ধর্ত্তব্যের মধ্যে ছিল না। সুতরাং সহজে চাকরি ছাড়িয়া দিলেন।
একাদশ পরিচ্ছেদ
চাকরি ছাড়িয়া দিয়া মুচিরাম ভদ্রকালীকে বলিলেন, “প্রিয়ে!” (তিনি সে কালের যাত্রার বাছা বাছা সম্বোধন পদগুলি ব্যবহার করিতেন) “প্রিয়ে!” বিষয় যেমন আছে-তেমনি একটি বাড়ী নাই। একটা বাড়ীর মত বাড়ী করিলে হয় না?”
ভদ্র। দাদা বলে, এখানে বড় বাড়ী করিলে, লোকে বল্বে, ঘুষের টাকায় বড় মানুষ হয়েছে।
মুচি। তা, এখানেই বা বাড়ী করায় কাজ কি? এখানে বুক পূরে বড়মানুষি করা যাবে না। চল, আর কোথাও গিয়া বাস করি।
ভদ্রকালী সম্মত হইলেন, কিন্তু নিজ পিত্রালয় যে গ্রামে, সেই গ্রামেই বাস করাই বিধেয় বলিয়া পরামর্শ দিলেন। ফলে ভদ্রকালী আর কোন গ্রামের নাম বড় জানিতেন না।
মুচিরাম বিনীতভাবে ইহাতে কিছু আপত্তি করিলেন। তিনি শুনিয়াছিলেন, যত বড়মানুষের বাড়ী কলিকাতায়-তিনিও বড়মানুষ, সুতরাং কলিকাতাই তাঁহার বাসযোগ্য, এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। এখন ভদ্রকালীর এক মাতুল, একদা কালীঘাটে পূজা দিতে আসিয়া, এক কালে কলিকাতা বেড়াইয়া গিয়াছিলেন, এবং বাটী গিয়া গল্প করিয়াছিলেন যে, কলিকাতার কুলকামিনীগণ সজ্জিতা হইয়া রাজপথ আলোকিত করে। ভদ্রকালীর সেই অবধি কলকাতাকে ভূতলস্থ স্বর্গ বলিয়া বোধ ছিল। তাঁহার অনেকগুলি অলঙ্কার হইয়াছে, পরিয়া সর্ব্বজননয়নপথবর্ত্তিনী হইতে পারিলে অলঙ্কারের সার্থকতা হয়-ভদ্রকালী তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় বাস করার প্রস্তাবে সম্মতা হইলেন।
তখন ভজগোবিন্দ ছুটি লইয়া, আগে কলিকাতায় বাড়ী কিনিতে আসিল। বাড়ীর দাম শুনিয়া মুচিরামের বাবুগিরির সাধ কিছু কমিয়া আসিল-যাহা হউক, টাকার অভাব ছিল না,-অট্টালিকা ক্রীত হইল। যথাকালে মুচিরাম ও ভদ্রকালী কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইয়া নূতন গৃহে বিরাজমান হইলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ভদ্রকালী কলিকাতায় আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার মনস্কামনা পূর্ণ হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। কলিকাতার কুলকামিনী রাজপথ আলোকিত করা দূরে থাকুক, পল্লীগ্রাম অপেক্ষা কঠিনতর কারাগারে নিবদ্ধ। যাহারা রাজপথ কলুষিত করিয়া দাঁড়ায়, তাহাদিগের শ্রেণীভুক্ত হইবার ইচ্ছা ভদ্রকালী রাখেন না-সুতরাং তাঁহার কলিকাতায় আসা বৃথা হইল। বিশেষ দেখিলেন, তাঁহার অঙ্গের অলঙ্কার দেখিয়া কলিকাতার স্ত্রীলোক হাসে। ভদ্রকালীর অলঙ্কারের গর্ব্ব ঘুচিয়া গেল।
মুচিরামের কলিকাতায় আসা বৃথা হইল না। তিনি প্রত্যহ গাড়ী করিয়া বাজার যাইতেন, এবং যাহা দেখিতেন, তাহাই কিনিতেন। বাবুটি নূতন আমদানি দেখিয়া বিক্রেতৃবর্গ পাঁচ টাকার জিনিষে দেড় শত টাকা হাঁকিত, এবং নিতান্তপক্ষে পঞ্চাশ টাকা না পাইলে ছাড়িত না। হঠাৎ মুচিরামের নাম বাজিয়া গেল যে, বাবুটি মধুচক্রবিশেষ। পাড়ার যত বানর মধু লুঠিতে ছুটিল। জুয়াচোর, বদমাশ, মাতাল, লম্পট, নিষ্কর্ম্মা ভাল ধুতি চাদর, জুতা ও লাঠিতে অঙ্গ পরিশোভিত করিয়া, চুল ফিরাইয়া, বাবুকে সম্ভাষণ করিতে আসিল। মুচিরাম তাহাদিগকে কলিকাতার বড় বড় বাবু মনে করিয়া তাহাদিগকে বিশেষ আদর করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহারাও আত্মীয়তা করিয়া তাঁহার বৈঠকখানায় আড্ডা করিল-তামাক পোড়ায়, খবরের কাগজ পড়ে, মদ খায়, তাস পেটে, বাজনা বাজায়, গান করে, পোলাও ধ্বংসায়, এবং বাবুর প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনিয়া আনে। টাকাটায় আপনার বার আনা মুনাফা রাখে, বলে দাঁওয়ে যোওয়ে সিকি দামে কিনিয়াছি। উভয় পক্ষের সুখের সীমা রহিল না।
যে গলিতে মুচিরাম বাড়ী লইয়াছিলেন, সেই গলিতে একজন প্রথমশ্রেণীর বাটপাড় বাস করিতেন। তাঁহার নাম রামচন্দ্র দত্ত। রামচন্দ্রবাবু প্রথমশ্রেণীর বাটপাড়-একটু ব্রান্ডি বা একখানা কাটলেটের লোভে কাহারও আনুগত্য করিবার লোক নহেন। তাঁহার ত্রিতল গৃহ, প্রস্তরমুকুর কাষ্ঠ কাচ কার্পেটাদিতে সকুসুম উদ্যানতুল্য রঞ্জিত; তাঁহার দরওয়াজায় অনেকগুলো দ্বারবান্ গালচাল্লা বাঁধিয়া সিদ্ধি ঘোঁটে; আস্তাবলে অনেকগুলি অশ্বের পদধ্বনি শুনা যায়-তিনখানা গাড়ি আছে, সোণাবাঁধা হুঁকা, হীরাবাঁধা গৃহিণী, হ্যাণ্ডনোটে বাঁধা ইংরেজ খাদক, এবং তাড়াবাঁধা ‘কাগজ’-সকলই ছিল। তথাপি তিনি জুয়াচোর-জুয়াচুরিতেই এ সকল হইয়াছিল। তিনি যখন শুনিলেন, টাকার বোঝা লইয়া গ্রাম্য গর্দ্দভ পাড়ায় আসিয়া চরিয়া বেড়াইতেছে, তখন ভাবিলেন যে, গর্দ্দভের পৃষ্ঠ হইতে টাকার বোঝাটি নামাইয়া লইয়া তাহার উপকার করিতে হইবে। আহা! অবোধ পশু! এত ভারি বোঝা বহিবে কি প্রকারে-বোঝাটি নামাইয়া লইয়া তাহার উপকার করি।
প্রথম প্রয়োজন, মুচিরামের সঙ্গে আলাপ পরিচয়। রামচন্দ্রবাবু বড়লোক-মুচিরামের বাড়ী আগে যাইবেন না। ইঙ্গিত পাইয়া একজন অনুচর মুচিরামের কাণে তুলিয়া দিল, রামচন্দ্রবাবু কলিকাতার অতি প্রধান লোক, আর মুচিরামের প্রতিবাসী-মুচিরামের সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য অতি ব্যস্ত। সুতরাং মুচিরাম গিয়া উপস্থিত।
এইরূপে উভয়ে উভয়ের নিকট পরিচিত হইলেন। উভয়ে উভয়ের বাড়ী যাতায়াত হইতে লাগিল। ঘন ঘন যাতায়াতে ক্রমে সৌহার্দ্দ্য বৃদ্ধি। রামচন্দ্রবাবুর সেই ইচ্ছা! তিনি চতুর, মুচিরাম নির্ব্বোধ; মুচিরাম গ্রাম্য, তিনি নাগরিক। অল্প কালেই মুচিরাম-মৎস্য ফাঁদে পড়িল-রামচন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুতা করিল। রামচন্দ্র তাঁহার মুরুব্বি হইলেন-মুচিরামের নাগরিক জীবনযাত্রানির্ব্বাহে শিক্ষাগুরু হইলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
তিনি নাগরিক জীবননির্ব্বাহে মুচিরামের শিক্ষাগুরু-কলিকাতারূপ গোচারণভূমে তাঁহার রাখাল-কালীঘাট হইতে চিতপুর পর্য্যন্ত, তখন মুচিরামবলদ সখের গাড়ি টানিয়া যায়, রামবাবু তখন তাহার গাড়োয়ান; সখের ছেকড়ায় এই খোঁড়া টাটুটি জুড়িয়া, রামচন্দ্র পাকা কোচমানের মত মিঠাকড়া চাবুক লাগাইতেন। তাঁহার হস্তে ক্রমে গ্রাম্য বানর সহুরে বানরে পরিণত হইল। কি গতিকের বানর, তাহা নিম্নোদ্ধৃত পত্রাংশ পড়িলেই বুঝা যাইতে পারে। এই সময় তিনি ভজগোবিন্দকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা হইতে উদ্ধৃত করা গেল-
“তোমার পুত্রের বিবাহ শুনিয়া আহ্লাদ হইল। টাকায় তেমন আনুকূল্য করিতে পারিলাম না-মাপ করিও। দুইখানা গাড়ি কিনিয়াছি-একখানা বেরুষ-একখানা ব্রৌনবেরি। একটা আরবের যুড়িতে ২২০০ টাকা পড়িয়াছে। ছবিতে, আয়নাতে, কারপেটে অনেক টাকা পড়িয়া গিয়াছে। কলিকাতার এত খরচ, তাহা জানিলে কখন আসিতাম না-সেখানে সাত সিকায় কাপড় ও মজুরিসমেত আমার একটা চাপকান তৈয়ার হইত-এখানে একটা চাপকানে ৮৫ টাকা পড়িয়াছে। এক সেট রূপার বাসনে অনেক টাকা লাগিয়াছে। থাল, বাটি, গেলাস, সে বাসনের কথা বলিতেছি না-এ সেট টেবিলের জন্য। বরকন্যাকে আমার হইয়া আশীর্ব্বাদ করিবে।”
এই হলো বানরামি নম্বর এক। তারপর, মুচিরাম কলিকাতায় যে কেহ একটু খ্যাতিযুক্ত, তাহারই বাড়ীতে, রামচন্দ্রবাবুর পশ্চাতে পশ্চাতে যাইতে আরম্ভ করিলেন। কোন নামজাদা বাবু তাঁহার বাড়ীতে আসিলে জন্ম সার্থক মনে করিতেন। কিসে আসে, সেই চেষ্টায় ফিরিতেন। এইরূপ আচরণে, রামবাবুর সাহায্যে, কলিকাতার সকল বর্দ্ধিষ্ণু লোকের সঙ্গে তাঁহার আলাপ হইল। টাকার মান সর্ব্বত্র; মুচিরামের টাকা আছে; সুতরাং সকলেরই কাছে তাঁহার মান হইল।
তারপর মুচিরাম কলিকাতার ইংরেজ মহল আক্রমণ করিলেন। রামবাবুর পরিচয়ে যত ছোট বড় ইংরেজের বাড়ী যাতায়াত করিলেন। অনেক জায়গাতেই ঝাঁটা লাথি খাইলেন। কোন কোন স্থানে মিষ্ট কথা পাইলেন। অনেক স্থানেই একজন মাতালো জমীদার বলিয়া পরিচিত হইলেন।
তারপর ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আসোসিয়েশ্যনে ঢুকিলেন। নাম লেখাইয়া বৎসর বৎসর টাকা দিতে লাগিলেন। রামচন্দ্রবাবুর সঙ্গে প্রতি অধিবেশনে যাইতে আরম্ভ করিলেন। রামবাবু কথিত মহামহিমমহাসভার “একটা বড় কামান |” তিনি যখনই বড় কামান দাগিতে যাইতেন, এই ছোট মুচিপিস্তলটি সঙ্গে লইয়া যাইতেন-সুতরাং পিস্তলটি ক্রমে মুখ খুলিয়া পুটপাট করিতে আরম্ভ করিল। মুচিরামও ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সভায় একজন বক্তা হইয়া দাঁড়াইলেন। তিনি বকিতেন মাথামুণ্ডু, কিন্তু ছাপার বিজ্ঞাপনীতে যাহা বাহির হইত, সে আর একপ্রকার। মুচিরাম নিজে তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেন না। যাহারা বুঝে, তাহারা পড়িয়া নিন্দা করিত না। সুতরাং মুচিরাম ক্রমে একজন প্রসিদ্ধ বক্তা বলিয়া খ্যাতি লাভ করিতে লাগিলেন। যেখানে লোকে বড়লোক বলিয়া গণ্য হয়, মুচিরাম তাহার কোন যায়গায় যাইতেই ছাড়িত না। গবর্ণমেণ্ট হৌসে ও বেলবিডীরে গেলে বড়লোক বলিয়া গণ্য হয়, সুতরাং সে গবর্ণমেণ্ট হৌসে ও বেলবিডীরে যাইত। যাইতে যাইতে সে লেপ্টেনান্ট গবর্ণরের নিকট সুপরিচিত হইল। লেপ্টেনাণ্ট গবর্ণর তাহাকে একজন নম্র, নিরহঙ্কারী, নিরীহ লোক বলিয়া জানিলেন। জমীদারী সভার একজন নায়ক বলিয়া পূর্ব্বেই রামচন্দ্রের নিকট পরিচয় পাইয়াছিলেন।
সম্প্রতি বাঙ্গাল কৌন্সিলে একটি পদ খালি হইল। একজন জমীদারী সভার অধিনায়ককে তাহাতে প্রতিষ্ঠিত করিবেন, ইহাই লেপ্টেনাণ্ট গবর্ণর স্থির করিলেন। বাছনি করিতে মনে মনে ভাবিলেন, “মুচিরামের ন্যায় এ পদের যোগ্য কে? নিরহঙ্কারী, নিরীহ-সেকেলে খাঁটি সোণা, একালের ঠন্ঠনে পিতল নয়। অতএব মুচিরামকে বহাল করিব |”
অচিরাৎ অনরেবল বাবু মুচিরাম রায় বাঙ্গাল কৌন্সিলে আসন গ্রহণ করিলেন।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
বড় বাড়াবাড়িতে অনরেবল মুচিরাম রায়ের রুধির শুকাইয়া আসিল। ভজগোবিন্দ ফিকিরফন্দিতে অল্প দামে অধিক লাভের বিষয়গুলি কিনিয়া দিয়াছিলেন-তাঁহার কার্য্যদক্ষতায় ক্রীত সম্পত্তির আয় বাড়িয়াছিল-কিন্তু এখন তাহাতেও অনাটন হইয়া আসিল। দুই একখানি তালুক বাঁধা পড়িল-রামচন্দ্রবাবুর কাছে। রামচন্দ্রবাবুর সঙ্কল্প এতদিনে সিদ্ধ হইয়া আসিতেছিল-এই জন্য তিনি আত্মীয়তা করিয়া মুচিরামকে এত বড় বাবু করিয়া তুলিয়াছিলেন। রামচন্দ্র অর্দ্ধেক মূল্যে তালুকগুলি বাঁধা রাখিলেন-জানেন যে, মুচিরাম কখনও শুধরাইতে পারিবে না- অর্দ্ধেক মূল্যে বিষয়গুলি তাঁহার হইবে। আরও তালুক বাঁধা পড়ে, এমন গতিক হইয়া আসিল। এই সময়ে ভজগোবিন্দ আসিয়া উপস্থিত হইল। সে শুনিয়াছিল যে, গবর্ণর প্রভৃতি বড় বড় সাহেব তাহার ভগিনীপতির হাতধরা-এই সুযোগে একটা বড় চাকরি যোটাইয়া লইতে হইবে-এই ভরসায় ছুটি লইয়া কলিকাতায় আসিলেন। আসিয়া শুনিলেন, মুচিরামের গতিক ভাল নহে। তাহার উদ্ধারের উপায় বলিয়া দিলেন।
বলিলেন, “মহাশয়, আপনি কখন তালুকে যান নাই। গেলেই কিছু পাওয়া যাইবে। তালুকে যান |”
মুচিরাম আনন্দিত হইল, ভাবিল, “তাই ত! এমন সোজা কথাটা আমার মনে আসিল না |” মুচিরাম খুশী হইয়া, ভজগোবিন্দের কথায় স্বীকৃত হইল।
চন্দনপুর নামে তালুক-সেইখানে বাবু গেলেন। প্রজাদিগের অবস্থা বড় ভাল। সে বৎসর নিকটবর্ত্তী স্থান সকলে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত-কিন্তু সে মহালে কিছু না। কখন মুচিরাম প্রজাদিগের নিকট মাঙ্গন মাথট লয়েন নাই। মুচিরাম নির্ব্বিরোধী লোক-তাহাদের উপর কোন অত্যাচার করিতেন না। আজ ভজগোবিন্দের পরামর্শে সশরীরে তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “আমার কন্যার বিবাহ উপস্থিত-বড় দায়গ্রস্ত হইয়াছি, কিছু ভিক্ষা দাও |” প্রজারা দয়া করিল-প্রজা সুখে থাকিলে জমীদারকে সকল সময়ে দয়া করিতে প্রস্তুত। জমীদার আসিয়াছে সম্বাদ পাইয়া, পালে পালে প্রজা টেঁকে টাকা লইয়া মুচিরাম-দর্শনে আসিতে আরম্ভ করিল। মুচিরামের চেষ্ট টাকায় পরিপূর্ণ হইতে লাগিল, কিন্তু ইহাতে আর একদিকে তাঁহার আর একপ্রকার সৌভাগ্যের উদয় হইল।
প্রজারা দলে দলে মুচিরাম দর্শনে আসে-কোন দিন পঞ্চাশ, কোন দিন ষাট, কোন দিন আশী, কোন দিন একশত এইরূপ। যাহাদের বাড়ী নিকট, তাহারা দর্শন করিয়া ফিরিয়া যায়, যাহাদের বাড়ী দূর, তাহারা দোকান হইতে খাদ্যসামগ্রী কিনিয়া একটা বাগানের ভিতর রাঁধিয়া বাড়িয়া খায়। মহালটি একে খুব বড়-মুচিরামের এত বড় জমীদারী আর নাই-তাহাতে গ্রামগুলির মধ্যে বিল খাল অনেক থাকায়, দুই চারিজন প্রজাকে প্রায় রাঁধিয়া খাইয়া যাইতে হইত। একদিন অনেক দূর হইতে প্রায় একশত প্রজা আসিয়াছে–তাহাদের বাড়ী একটা ভারি জলা পার; নিকাশ প্রকাশে তাহাদের বেলা গেল; তাহারা বাড়ী ফিরিতে পারিল না। বাগানে রাঁধাবাড়া করিতে লাগিল। রাত্রি থাকিয়া প্রাতে যাত্রা করিবে। তাহারা যখন খাইতে বসিল, সেই সময়ে নিকটস্থ মাঠ পার হইয়া অশ্বযানে, একটি সাহেব যাইতেছিলেন।
সাহেবটির নাম মীন্ওয়েল্। তিনি ঐ জেলার প্রধান রাজপুরুষ-ম্যাজিষ্ট্রেট কালেক্টর। সাহেবটি ভাল লোক-ন্যায়বান্-হিতৈষী এবং পরিশ্রমী। কিসে এ দেশের লোকের মঙ্গল সাধন করিবেন, সেই জন্য সর্ব্বদা চিন্তিত। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে বৎসর ঐ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল; সাহেব দুর্ভিক্ষের তদারকে বাহির হইয়াছিলেন। নিকটস্থ কোন গ্রামে তাঁহার তাম্বু পড়িয়াছিল-তিনি এখন অশ্বারোহণে তাম্বুতে যাইতেছিলেন। যাইতে যাইতে দেখিতে পাইলেন, একটা বাগানের ভিতর কতকগুলা লোক ভোজন করিতেছে।
দেখিয়াই সহজেই সিদ্ধান্ত করিলেন, ইহারা সকলে দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসী দরিদ্র লোক, কোন বদান্য ব্যক্তি ইহাদের ভোজন করাইতেছে। সবিশেষে তত্ত্ব জানিবার জন্য, নিকটে একজন চাষাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন।
চাষা অবশ্য ইংরেজি জানে না। সাহেব উত্তম বাঙ্গালা জানেন, পরীক্ষা দিয়া পুরস্কার পাইয়াছেন; সুতরাং চাষার সঙ্গে বাঙ্গালায় কথোপকথন আরম্ভ করিলেন।
সাহেব চাষাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাডিগের গ্ড়ামে1 ডুড়্বেক্কা2 কেমন আছে?” চাষা তো জানে না ডুড়্বেক্কা কাহাকে বলে। সে ফাঁফরে পড়িল। ডুড়্বেক্কা কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম হইবে, ইহা একপ্রকার স্থির হইল। কিন্তু “কেমন আছে?” ইহার উত্তর কি দিবে? যদি বলে যে, সে ব্যক্তিকে আমি চিনি না, তাহা হইলে সাহেব হয়ত এক ঘা চাবুক দিবে, যদি বলে যে, ভাল আছে, তাহা হইলে সাহেব হয়ত ডুড়্বেক্কাকে ডাকিয়া আনিতে বলিবে; তাহা হইলে কি করিবে? চাষা ভাবিয়া চিন্তিয়া উত্তর করিল, “বেমার আছে |”
“বেমার-Sick?” সাহেব ভাবিতে লাগিলেন, “Well, there may be much sickness without there being any scarcity-the fellow does not understand perhaps; these people are so dull-I say ডুড়্বেক্কা কেমন আছে-অঢিক আছে কিংবা অল্প আছে?”
এখন চাষা কিছু ভাব পাইল। স্থির করিল যে, এ যখন সাহেব, তবে অবশ্য হাকিম। (সে দেশের নীলকর নাই) হাকিম যখন জিজ্ঞাসা করিতেছে যে, ডুড়্বেক্কা অধিক আছে, কি অল্প আছে-তখন ডুড়্বেক্কা একটা টেক্সের নাম না হইয়া যায় না। ভাবিল, কই, আমরা ত ডুড়্বেক্কার টেক্স দিই না; কিন্তু যদি বলি, আমাদের গ্রামে সে টেক্স নাই-তবে বেটা এখনই টেক্স বসাইয়া যাইবে। অতএব মিছা কথা বলাই ভাল। সাহেব পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাডের গ্ড়ামে ডুড়্বেক্কা অঢিক কিম্বা অল্প আছে?”
চাষা উত্তর করিল, “হুঁজুর, আমাদের গাঁয়ে ভারি ডুড়্বেক্কা আছে |”
সাহেব ভাবিলেন, “Hump! I thought as much___” পরে বাগানে যে সকল লোক খাইতেছিল, তৎপ্রতি অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে বোজন করিল?” (উদ্দেশ্য “ভোজন করাইল”)
চাষা। প্রজারা ভোজন কোচ্ছে।
সাহেব চটিয়া, “টাহা আমি জানে-They eat, that I see-but who pays?-টাকা কাহাড়?”
এখন সে চাষা জানে যে, যত টাকা আসিতেছে, সকলই জমীদারের সিন্ধুকে যাইতেছে; সে নিজেও কিছু দিয়া আসিয়াছিল-অতএব এবার বিনা বিলম্বে উত্তর করিল, “টাকা জমীদারের |”
সাহেব। Ah! there it is; they do their duty-how it is that some people find pleasure in maligning them? জমীদারের নাম কি?
চাষা। মুচিরাম রায়।
সাহেব। কট ডিবস বোজন কড়িয়াছে?
চাষা। তা ধর্ম্মাবতার, প্রজারা, রোজ রোজ আসে, খাওয়া দাওয়া করে।
সাহেব। এ গ্ড়ামের নাম কি?
চাষা। চন্ননপুর।
সাহেব নোটবুক বাহির করিয়া তাহাতে পেন্সিলে লিখিলেন,
For Famine Report
“Babu Muchiram Ray, Zemindar of Chinnapur-feeds every day a large number of his ryots.”
সাহেব তখন ঘোড়ায় চাবুক মারিয়া টাপে চলিলেন। চাষা আসিয়া গ্রামে রটাইল, একটা সাহেব টাকায় আট আনা হিসাবে টেক্স বসাইতে আসিয়াছিল, চাষা মহাশয়ের বুদ্ধিকৌশলে বিমুখ হইয়াছে।
ঐ দিকে মীন্ওয়েল্ সাহেব যথাকালে ফেমিন্ রিপোর্টে লিখিলেন। একটা প্যারাগ্রাফ শুধু মুচিরাম রায় সম্বন্ধে। তাহাতে প্রতিপন্ন হইল যে, মুচিরাম জমীদারদিগের আদর্শস্থল। এই দুঃসময়ে অন্নদান করিয়া সকল প্রজাগুলির প্রাণরক্ষা করিয়াছে।
রিপোর্ট কমিশ্যনরীতে গেল। কমিশ্যনরের হস্ত হইতে কিছু উজ্জ্বলতর বর্ণে রঞ্জিত হইয়া-কমিশ্যনর সাহেব লেখক ভাল-গবর্ণমেণ্টে গেল। গবর্ণমেণটের এই বিবেচনা-যে যার প্রজা, সেই যদি দুর্ভিক্ষের সময়ে তাহাদের আহার যোগায়, তাহা হইলেই “দুর্ভিক্ষ প্রশ্নের” উত্তম মীমাংসা হয়। অতএব মুচিরামের ন্যায় বদান্য জমীদারদিগের সম্মানিত ও উৎসাহিত করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। তজ্জন্য বাঙ্গালা গবর্ণমেণ্ট ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেণ্টের নিকট অনুরোধ করিলেন যে, বাবু মুচিরাম রায় মহাশয়কে-পাঠক একবার হরি হরি বল-রাজাবাহাদুর উপাধি দেওয়া যায়।
ইণ্ডিয়ান গবর্ণমেণ্ট বলিলেন, তথাস্তু। গেজেট হইল, রাজা মুচিরাম রায় বাহাদুর। তোমরা সবাই আর একবার হরি বল।
http://sabjanta.info/মুচিরাম-গুড়ের-জীবনচরিত/