রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম দৃশ্য
রায় কৃষ্ণকিশোর বাহাদুর মৃত্যুশয্যায় শয়ান
চন্দ্রকিশোর, নন্দকিশোর ও ইন্দ্রকিশোর পুত্রত্রয় পরামর্শে রত
ডাক্তার উপস্থিত। মহিলাগণ ক্রন্দনোন্মুখী
চন্দ্র – কাকে কাকে লিখি ?
ইন্দ্র – রেনল্ড্স্-সায়েবকে লেখো ।
কৃষ্ণ – ( অতিকষ্টে ) কী লিখবে বাবা!
নন্দ – তোমার মৃত্যুসংবাদ ।
কৃষ্ণ – এখনো তো মরি নি বাবা!
ইন্দ্র – এখনি নেই বা মলে , কিন্তু একটা সময় স্থির করে লিখতে হবে তো ।
চন্দ্র – যত শীঘ্র পারি সাহেবদের কন্ডোলেন্স্ লেটারগুলো আদায় করে কাগজে ছাপিয়ে ফেলা দরকার , এর পরে জুড়িয়ে গেলে ছাপিয়ে তেমন ফল হবে না ।
কৃষ্ণ – রোসো বাবা , আগে আমি জুড়িয়ে যাই ।
নন্দ – সবুর করলে চলবে না বাবা! সিমলে দার্জিলিঙে যাদের যাদের চিঠি পাঠাতে হবে তাদের একটা ফর্দ করা যাক । ব’লে যাও ।
চন্দ্র – লাট-সায়েব , ইলবর্ট্-সায়েব , উইলসন্-সায়েব , বেরেস্ফোর্ড , মেকলে , পিকক-
কৃষ্ণ – বাবা , কানের কাছে ও কী নামগুলো করছ , তার চেয়ে ভগবানের নাম করো । অন্তিমে তিনিই সহায় । হরি হে —
ইন্দ্র – ভালো মনে করিয়ে দিয়েছ , হ্যারিসন-সায়েবকে ধরা হয় নি ।
কৃষ্ণ – বাবা , বলো রাম রাম-
নন্দ – তাই তো , রামজে-সায়েবকে তো ভুলেছিলুম ।
কৃষ্ণ – নারায়ণ নারায়ণ!
চন্দ্র – নন্দ , লেখো তো , নোরান-সায়েবের নামটা লেখো তো ।
স্কন্দকিশোরের প্রবেশ
স্কন্দ – বা , তোমরা বেশ তো! আসল কাজটাই তো বাকি ।
চন্দ্র – কী বলো তো ।
স্কন্দ – ঘাটে যাবার প্রোসেশ্যনে যারা যোগ দেবে তাদের তো আগে থাকতে খবর দেওয়া চাই ।
কৃষ্ণ – বাবা , কোন্টা আসল হল । আগে তো মরতে হবে , তার পরে —
চন্দ্র – সেজন্য ভাবনা নেই । ডাক্তার!
ডাক্তার – আজ্ঞে!
চন্দ্র – বাবার আর কত বাকি ? সাধারণকে কখন আসতে বলব ?
ডাক্তার – বোধ হয়-
( – রমণীদের রোদন – )
স্কন্দ – ( বিরক্ত হইয়া) মা , তুমি তো ভারি উৎপাত আরম্ভ করলে! আগে কথাটা জিজ্ঞাসা করে নিই । কখন ডাক্তার ?
ডাক্তার – বোধ হয় রাত্রি-
( – রমণীদের পুনশ্চ ক্রন্দন – )
নন্দ – এ তো মুশকিল হল । কাজের সময় এমন করলে তো চলে না । তোমাদের কান্নায় ফল কী ? আমরা বড়ো বড়ো সায়েবদের কাঁদুনি চিঠি কাগজে ছাপিয়ে দেব ।
( – রমণীগণকে বহিষ্করণ – )
স্কন্দ – ডাক্তার , কী বোধ হচ্ছে ?
ডাক্তার – যেরকম দেখছি আজ রাত্রি চারটের সময়েই বা হয়ে যায় ।
চন্দ্র – তবে তো আর সময় — নন্দ , যাও ছুটে যাও , স্লিপগুলো দাঁড়িয়ে থেকে ছাপিয়ে আনো ।
ডাক্তার – কিন্তু ওষুধটা আগে-
স্কন্দ – আরে , তোমার ডাক্তারখানা তো পালিয়ে যাচ্ছে না । প্রেস বন্ধ হলে যে মুশকিলে পড়তে হবে ।
ডাক্তার – আজ্ঞে , রুগি যে ততক্ষণে —
চন্দ্র – সেইজন্যই তো তাড়াতাড়ি — পাছে স্লিপ ছাপার আগেই রুগি-
নন্দ – এই আমি চললুম ।
স্কন্দ – লিখে দিয়ো , কাল আটটার সময় প্রোসেশ্যন আরম্ভ হবে ।
দ্বিতীয় দৃশ্য
স্কন্দ – কই ডাক্তার , চারটে ছেড়ে সাতটা বাজল যে!
ডাক্তার – ( অপ্রতিভ ভাবে) তাই তো , নাড়ী এখনো বেশ সবল আছে ।
চন্দ্র – বা , তুমি তো বেশ ডাক্তার! আচ্ছা বিপদে ফেলেছ!
নন্দ – ওষুধটা আনতে দেরি করেই বিপদ ঘটল । ডাক্তারের ওষুধ বন্ধ হয়েই বাবা বল পেয়েছেন ।
কৃষ্ণ – এতক্ষণ তোমরা প্রফুল্ল ছিলে , হঠাৎ বিমর্ষ হলে কেন ? আমি তো ভালোই বোধ করছি ।
স্কন্দ – আমরা যে ভালো বোধ করছি নে । ঘাটে যাবার এন্গেজমেন্ট যে করে বসেছি ।
কৃষ্ণ – তাই তো! আমার মরা উচিত ছিল ।
ডাক্তার – ( অসহ্য হইয়া ) এক কাজ কর তো সব গোল চুকে যায় ।
ইন্দ্র – কী ?
স্কন্দ – কী ?
চন্দ্র – কী ?
নন্দ – কী ?
ডাক্তার – ওঁর বদলে তোমরা যদি কেউ সময়মত মর ।
তৃতীয় দৃশ্য
বহির্বাটিতে লোকসমাগম
কানাই – ওহে , সাড়ে-আটটা বাজল । দেরি কিসের ?
চন্দ্র – বসুন , একটু তামাক খান ।
কানাই – তামাক তো সকাল থেকেই খাচ্ছি ।
বলাই – কই হে , তোমাদের জোগাড় তো কিছুই দেখি নে ।
চন্দ্র – জোগাড় সমস্তই আছে — আমাদের কোনো ত্রুটি নেই — এখন কেবল-
রামতারণ – কী হে চন্দ্র , আর দেরি করা তো ভালো হয় না ।
চন্দ্র – সে কি আমি বুঝি নে — কিন্তু-
হরিহর – দেরি কিসের জন্যে হচ্ছে ? আপিসের বেলা হয় যে , কাণ্ডখানা কী!
( – ইন্দ্রকিশোরের প্রবেশ – )
ইন্দ্র – ব্যস্ত হবেন না , হল বলে । ততক্ষণ কন্ডোলেন্স্ লেটারগুলো পড়ুন ।
হাতে হাতে বিলি
এটা ল্যাম্বার্টের , এটা হ্যারিসনের , এটা সার জেম্স্-
( – স্কন্দকিশোরের প্রবেশ – )
স্কন্দ – এই নিন , ততক্ষণ কাগজে বাবার মৃত্যুর বিবরণ পড়ুন । এই স্টেট্স্ম্যান , এই ইংলিশম্যান ।
মধুসূদন – ( যাদবের প্রতি ) দেখছ ভাই , বাঙালি পাংচুয়ালিটি কাকে বলে জানে না ।
ইন্দ্র – ঠিক বলেছেন । মরবে তবু পাংচুয়াল হবে না ।
খবরের কাগজ ও কন্ডোলেন্স পত্র পড়িতে পড়িতে অভ্যাগতগণের অশ্রুপাত
রাধামোহন – ( সজল নেত্রে) হরি হে দীনবন্ধু!
নয়ানচাঁদ – হায় হায় , এমন লোকেরও এমন বিপদ ঘটে!
নবদ্বীপচন্দ্র – ( সনিশ্বাসে ) প্রভু , তোমারই ইচ্ছা !
রসিক – ‘ হৃদয়বৃন্তে ফুটে যে কমল ‘ — তার পরে কী ভুলে যাচ্ছি-
‘ হৃদয়বৃন্তে ফুটে যে কমল
তাহারে কাল অকালে ছিঁড়িলে হৃদয়-
মৃণাল ডুবে শোকসাগরের জলে । ‘
এও ঠিক তাই । হৃদয়মৃণাল শোকসাগরের জলে! আহা!
আড্যি এস্কোয়ার । O tempora! O mores !
তর্কবাগীশ। চলচ্চিত্তং চলদ্বিত্তং চলজ্জীবন-হায় হায় হায়।
ন্যায়বাগীশ। যদুপতেঃ ক্ক গতা মথুরাপুরী, রঘুপতেঃ
[কন্ঠরোধ]
দঃখীরাম । হায় কৃষ্ণকিশোর বাহাদর , তুমি কোথায় গেলে!
নেপথ্য হইতে ক্ষীণকন্ঠ । আমি এইখানেই আছি বাবা! দোহাই , তোরা অত চেঁচাস নে ।