আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: ভারতীয় রসায়নের জনক ও এক মনীষী

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
Picture credit: telegraphindia.com

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, প্রখ্যাত রসায়নবিদ, শিক্ষাবিদ, শিল্পপতি ও ভারতীয় রসায়নের জনক। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেন। এই বেঙ্গল কেমিকলস হল ভারতের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় 1861 সালের 2 আগস্ট বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার জন্মগ্রহণ করেন এবং 16 জুন 1944 তারিখে 82 বছর বয়সে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর মায়ের নাম ভূবনমোহিনী দেবী এবং পিতার নাম হরিশচন্দ্র রায়। জমিদার বংশের সন্তান হলেও অত্যন্ত সাদামাটা জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় : ছাত্র জীবন

1874 সালে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতায় অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই 1878 সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। 1881 সালে সেখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে প্রেসিডেন্সী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন।

প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় কলেজে তৎকালীন রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন আলেক্সান্ডার পেডলার। পেডলার মূলত তার শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক দিকের চেয়ে ব্যবহারিক দিককে বেশি গুরুত্ব দিতেন। রসায়নের চমকপ্রদ এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে অতি সহজেই তিনি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতেন । তরুণ প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন তার গুণমুগ্ধ শ্রোতা। পেডলার কলেজ ল্যাবে যেসব এক্সপেরিমেন্ট করতেন তিনি বাড়ি ফিরে তার নিজের বানানো রসায়ন ল্যাবে সেই একই পরীক্ষাগুলো পুনরায় করতেন। মূলত রসায়নের প্রতি তার ভালোলাগার শুরু ওখান থেকেই। যদিও তার প্রথম ভালোবাসা ছিল সাহিত্য। যার ধারাবাহিকতায় তিনি ঘরে বসেই ল্যাটিন ও ফ্রেঞ্চ ভাষা রপ্ত করেন।

কিন্তু পরবর্তী কালে তিনি রসায়নেই পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সম্মানসূচক গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমান স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গে । সেখান থেকে বিএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন । তার থিসিসের বিষয় ছিল “কনজুগেটেড সালফেট অফ কপার ম্যাগনেসিয়াম গ্রুপ”। তার অসাধারণ গবেষনার জন্য তিনি সে বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোপ পুরষ্কার লাভ করেন এবং আরো এক বছর থিসিস করার অনুমতি পান। তার জ্ঞানের গভীরতা, দায়িত্বশীলতা, সুন্দর আচরণে তার সহপাঠী ও শিক্ষকগণ এতোই মুগ্ধ ছিলেন যে তাকে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকেল সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়।

আরও পড়ুন: বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা – সত্যেন্দ্রনাথ বসু

সেই সময়ের আরো একটি ঘটনা থেকে আমরা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের তেজস্বীতার পরিচয় পাই । 1885 সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলার স্যার স্টারফোরড নর্থকোর্ট এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন যার বিষয়বস্তু ছিল “ব্রিটিশ দাসত্বের আগে ও পরে উপমহাদেশের চালচিত্র।” প্রফুল্ল চন্দ্র এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি তার প্রবন্ধে তুলে ধরেন কিভাবে উপমহাদেশীয় ব্রিটিশ শাসকরা শিক্ষা সংস্কার এর দিকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যায় অবিচার ও লুটপাটের দিকে অধিক ঝুকে পড়ছে। যদিও তিনি ওই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতেন নি, কিন্তু তার উচ্চমার্গীয় ও সোজাসাপ্টা কথা বিচারকদের মুগ্ধ করে।

1888 সালে প্রফুল্ল চন্দ্র মাতৃভূমির শিক্ষা ও গবেষণার প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেসময়ে ব্রিটিশরা শিক্ষক সমাজের জন্য দুটি আলাদা স্তরের সৃষ্টি করেছিল। ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ও প্রভিন্সিয়াল সার্ভিস । ইম্পেরিয়ালের অধীনে থাকতো ব্রিটিশ শিক্ষকরা। তারা উচ্চ বেতন ও গবেষনার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পেত। যার ফলে এডিনবার্গের মত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করে এসেও প্রফুল্ল চন্দ্র রায় মাত্র ২৫০ টাকার নাম সর্বস্ব বেতনে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদান করেন। তখনকার আরেক বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুও ছিলেন একই বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন । তবে প্রফুল্ল চন্দ্র থেমে থাকেননি, সব বাধা মেনে নিয়েই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন।

সীমাবদ্ধতাকে শক্তি হিসেবে কাজে লাগান তিনি। হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়েই তিনি রসায়নের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারতেন ও শিক্ষার্থীদের কাছে চমত্কার ভাবে উপস্থাপন করতেন। তবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন রসায়নকে শুধু শ্রেণী কক্ষে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না, একে কাজে লাগাতে হবে, গবেষনা করতে হবে। তিনি জানতেন যে ভবিষ্যত ভারতের উন্নয়ন নির্ভর করবে গবেষনার উপর । তাই তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার বীজ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন । যারা প্রতিনিধিত্ব করবে সমগ্র দেশের।

ভারতীয় রসায়নের জনক : আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

ভারতীয় রসায়নের জনক
Picture credit: newsbharati.com

তিনি শুধু ভালো মেধাবী শিক্ষার্থীই চান নি চেয়েছিলেন একদল দেশপ্রেমী মেধাবী। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় নিজে কিছু ত্যগী মেধাবীকে এক ছাদের নিচে জড়ো করেছিলেন এবং তাদের নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক দল গড়ে তোলেন । এই দলের অনেক মেধাবী (পঞ্চানন নিয়োগী, নিল রতন ধর, প্রিয়াদা রঞ্জন রায়, বিরেশ চন্দ্র গুহ, এস এস ভাটনগর প্রমুখ) পরবর্তীতে সারা ভারতবর্ষে বিজ্ঞান গবেষনার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছিলেন।

তৎকালীন সময়ে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় নিজে প্রায় রসায়নের 150 টি গবেষনা পত্র প্রকাশ করেছিলেন, যার 60 টি প্রকাশ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সংস্থা রয়েল সোসাইটির সংবাদপত্রে।

তিনি 1895 খ্রিস্টাব্দে মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার সমগ্র জীবনে মোট 12 টি যৌগিক লবণ এবং 5 টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।

1916 সালে প্রফুল্ল চন্দ্র প্রেসিডেন্সী কলেজ ছেড়ে বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করেন। 1921 সালে 60 বছর বয়সে তিনি তার পরবর্তী সমস্ত বেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যানে উৎসর্গ করেন। যা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেলোশিপকারীদের ২ লাখ টাকা করে প্রদান করা হয়। এভাবে তিনি 75 বছর বয়স পর্যন্ত বিনা বেতনে শিক্ষাদান করে গেছেন।

জীবনের শেষ 20 বছর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কাটান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি ঘরে । মাথার উপর পাখাকেও তিনি বিলাস দ্রব্য মনে করে ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানান। তখনকার দিনে একটি নিয়ম ছিল শিক্ষক যখন ক্লাস নিতেন তার আগে একজন কর্মচারী এসে ব্ল্যাকবোর্ড ও টেবল মুছে দিত । এক শীতের দিনে দেখা গেল একজন কর্মচারী কোট পরে ব্ল্যাকবোর্ড মুছতে এল। কিছুক্ষন পর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ওই একই রকম একটি কোট পরে ক্লাসে প্রবেশ করলেন। পরে জানা গেল যে তিনি একই কাপড় থেকে দুটি কোট তৈরি করান, একটি তার জন্য আরেকটি ওই কর্মচারীর জন্য। দৈনিক আহারে তিনি কখনও ১ পয়সার বেশি খরচ করতেন না, কিন্তু কেউ সাহায্য চাইলে হাজার টাকা দিতেও কুন্ঠাবোধ করতেন না ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top