বিশ্বের বিজ্ঞান জগতে একটি বিশিষ্ট নাম-প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। জন্ম কলকাতায় ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে ২৯ জুন তারিখে। ১৯০৮ সালে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন ও ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক হন। ইংলণ্ডে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে ট্রাইপস লাভ করে বিখ্যাত ক্যাভেনডিশ ল্যাবরীটরিতে গবেষণা করার সুযোগ পান পদার্থ বিজ্ঞানে। সেই সময় ক্যাভেনডিশ ল্যাবরীটরিতে ছিলেন দুই বিশাল মাপের বিজ্ঞানী-জে জে টমসন ও সি টি আর উইলসন। গবেষণায় যোগ দেবার আগে কিছু দিনের জন্য যখন দেশে আসছেন বাবা-মা-র সঙ্গে দেখা করতে, তখন কিংস কলেজের পাঠাগারের হাতে এল বায়োমেট্রিকার কয়েকটি পত্রিকা-কার্ল পিয়ার্সন সম্পাদিত। কিনে ফেললেন কিছু পত্রিকা এবং জাহাজেই পড়ে ফেললেন পত্রিকাগুলো। এতই মুগ্ধ হলেন যে, গবেষণার বিষয় পাল্টে ফেললেন – স্ট্যাটিস্টিক্স বা রাশিবিজ্ঞানে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ফিরে যাওয়া হল না। প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থ বিঞ্জানের সহকারী অধ্যাপকের কাজ নিলেন, সেইখানে বেকার ল্যাবরেটরীতে একপাশে রাশিবিজ্ঞানের ছোট গবেষণাগার স্থাপন করলেন। শুরু হল ভারতবর্ষে রাশিবিঞ্জানের চর্চা ও গবেষণা।
প্রশান্তচন্দ্র বিশ্ববিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী রোনাল্ড ফিসারের ভাবনা-অবলম্বী ছিলেন। জনসাধারণের প্রয়োজনে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা -এই মনোভাব প্রশান্তচন্দ্রের সামনে এনে দিল দুইটি সমস্যা-
(১) পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী দুই বা অধিক গোষ্ঠি একই জাতি থেকে উদ্ভুত হতে পারে কিনা;
(২) ভারত কৃষি-প্রধান দেশ; কৃষিতে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগে উন্নত অবস্থা সৃষ্টি করা যায় কিনা।
দুটো বিষয়ে একই সঙ্গে কাজ শুরু করলেন তিনি।
১৯২৭ সালে তিনি কার্ল পিয়ার্সনের গবেষণাগারে গেলেন পিয়ার্সন-আবিষ্কৃত ‘রেশিয়াল লাইক্নেস্ ফাংশন কো-এফিসিয়েন্ট (সি-আর-এল)’-এর বিষয়ে শিক্ষা নিতে। ১৯৩০ সালে প্রকাশ করলেন বিখ্যাত গবেষণাপত্র-আত্মপ্রকাশ করল প্রশান্তচন্দ্র আবিষ্কৃত ‘ভি-টু-স্ট্যাটিস্টিক্স’। বিশ্বের দরবারে ঠাঁই পেলেন তিনি। কৃষিবিজ্ঞানে অধ্যাপক মহলানবিশের অবদান ‘ডিজাইন অব্ এক্সপেরিমেন্ট’ নামে খ্যাত-যা পরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহিত হয়েছে। এই গবেষণাপত্র তাঁকে বিশ্বের দরবারে স্থায়ী আসন এনে দিল। পরাধীন ভারতের নাগরিক হয়ে এই সম্মান অর্জন অসামান্য বই কি।
প্রচণ্ড কর্মোদ্যমতা ও নিষ্ঠা ধীরে ধীরে তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিল। বেকার ল্যাবরেটরীর রাশিবিজ্ঞানের ছোট গবেষণাগার ১৯৩২ সালের ২৮শে এপ্রিলে রূপান্তরিত হল ‘ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিট্যুটে’ (আই-এস-আই)। ১৯৩৩ সালে প্রশান্তচন্দ্র শুরু করলেন পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের গবেষণা পত্রিকা ‘সংখ্যা’, যেটা কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বখ্যাত হল।
পরিসংখ্যান শিক্ষাক্রমের স্নাতকোত্তরে পঠন পাঠন ভারতে শুরু হল আই-এস-আই-তে। কয়েক বছর পর ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালু করল রাশিবিজ্ঞানে, তখন প্রশান্তচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগের প্রধান। ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ে-স্তরে রাশিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পঠন পাঠন ও গবেষণা এই প্রথম।
আই-এস-আই-তে থাকাকালীন তার নতুন অবদান ‘লার্জ স্ফেল স্যাম্পল্ সার্ভে মেথড’ বা ব্যাপক নমুনা সমীক্ষা পদ্ধতি। সারা বাংলায় কত পরিমাণ পাঠ উৎপাদিত হতে পারে-তা হিসাব করতে প্রয়োগ করলেন এই পদ্ধতিতে। বিশ্বজয় করলেন প্রশান্তচন্দ্র। বিশ্বের প্রথম সারির গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে আদৃত হল আই-এস-আই। পরবর্তী অবদান আবহাওয়াবিঞ্জানে পরিসংখ্যান- পদ্ধতিগুলির প্রয়োগ। আবহাওয়াবিদ হিসাবে তাঁর অভিঞ্জতা এখানে কাজ দিয়েছিল। এই গবেষণার ফলশ্রুতি হল তার মতবাদ- ভূপৃষ্ঠের আবওহায়া সর্বাধিক নিয়ন্ত্রিত হয় সমুদ্রতলের ৪ কিলোমিটার উপরে। এই মতবাদ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন নি আবহাওয়াবিজ্ঞানিরা- সময় লেগেছিল বেশ কয়েক বছর। রাশিবিজ্ঞানের আরো একটি প্রয়োগ শিল্পক্ষেত্রে- ভারতে প্রথম- ‘স্ট্যাটিস্টিকাল কোয়ালিটি কন্ট্রোল’ বা স-কিউ-সি।
অধ্যাপক মহলানবিশ বিশ্বাস করতেন যে, বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞান মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তার প্রচেষ্টায় আই-এস-আই-এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে ভারতের নানা শহরে যথা, দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, পুনে, মহিশুর, বরদা, ত্রিবান্দ্রাম, কোয়াম্বাটুর, গিরিডি, ইত্যাদি। স্বাধীন ভারতের সরকার আই-এস-আই-কে রূপান্তরিত করলেন ‘ডিম্ড বিশ্ববিদ্যালয়’-এ। আই-এস-আই-তে নানা বিভাগ, যেমন কেমিস্ট্রি, বটানি, বায়ো-কেমিস্ট্রি, কম্পিউটার সায়িন্স, মাইকোমেট্রি, গ্রুপ সায়িন্স, জিওলজি, ইকনমিক্স্, লিঙ্গুয়িস্টিকস্, প্ল্যানিং, ন্যাশেনাল ইনকাম, ইত্যাদি। দেশ-বিদেশের ঞ্জানীগুণীরা আসতে লাগলেন আই-এস-আই-তে।
ভারতের স্বাধীনতালাভের পর প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু তাঁকে আহ্বান করলেন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়া রুপায়ণে। পরিকল্পনা এবং অর্থনীতিতে রাশিবিজ্ঞান প্রবেশ করল। ১৯৫৫ সালে ভারতীয় যোজনা কমিশনের সদস্য হলেন। এই সময়েই প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা বিখ্যাত বই ‘দ্য অ্যাপ্রোচ্ টু অপারেশনাল রিসার্চ টু প্ল্যানিং ইন ইণ্ডিয়া’।
এই কর্মবীর নিজ কীর্তির স্বাক্ষর রাখলেন নানা সংস্থা স্থাপন করে, যেমন, ন্যাশনাল স্যাম্পল্ সার্ভে (এন-এস-এস)- জাতীয় স্তরে; রাজ্য স্তরে প্রতিটি রাজ্যে স্টেট স্ট্যাটিস্টিকাল ব্যুরো ও এদের তদরকীর জন্য সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন; এই বিভাগে যাঁরা কাজ করবেন-তাদের জন্য স্বতন্ত্র কর্মীশ্রেণী ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল সার্ভিস বা আই-এস-এস।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন- বছর দশেক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সচিব ছিলেন। অজস্র সম্মান পেয়েছেন জীবনে- যেমন, ১৯৪৫ সালে রয়েল সোসাইটির সদস্য (এফ-আর-এস), ইউনাইটেড নেশন স্ট্যাটিস্টিকাল কমিশনের সভাপতিপদ, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিট্যুটের সভাপতিপদ, সোভিয়েট রাশিয়ার সায়িন্স একাডেমীর সদস্যপদ, অক্সফর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ওয়েণ্ডেন মেডেল, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত দেশিকোত্তম উপাধি, ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মবিভূষণ, ভারতীয় বিঞ্জান কংগ্রেসের মূল সভাপতি, ইত্যাদি।
এই মনীষীর মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৯৭২ সালে, ৭৯ বছর বয়সে।