বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক অগ্রদৃষ্টিমান চিন্তানায়ক ও কর্মনেতা। জন্ম আধুনিক হুগলি (তখনকার বর্ধমান) জেলার আন্তর্গত রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কুলীন (বন্দোপাধ্যায়) ব্রাক্ষ্মণবংশে। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সুত্রেই বোধ করি এদের ‘রায়’ পদবীর ব্যবহার। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠপুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। পিতা রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র-জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈত্রিক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শবর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে সপরিবারে উঠে যান। রামমোহন সংস্কৃত পড়েন ও ফারসী শেখেন। তাঁর ফারসী ও আরবী শিক্ষা রাধানগরের শিক্ষিত মুসলমানদের কাছেই। ফারসী-আরবী পড়ে তাঁর মনে প্রচলিত হিন্দুধর্মের আচার-বিচার সম্বন্ধে সংশয় জাগে। অনুমান হয়, এ নিয়ে পিতামাতার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানাস্থানে ঘোরেন। কাশীতে ও সম্ভবতঃ পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তাঁর সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়। রামমোহনের সংস্কৃতে বুত পত্তি, তাঁর বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের সহযোগিতায় হয়েছিল। ব্রক্ষ্ম-উপাসনায় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তাঁর দষ্কিণ-হস্ত ছিলেন।
তাঁর তিন বিবাহ। প্রথম পত্নী অকালে মৃত। দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভে তাঁর দুই পুত্রের জন্ম হয়-রাধাপ্রসাদ ও রমাপ্রসাদ । ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দের পর রামমোহন অর্থোপার্জনে মন দেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং নবাগত সিভিলিয়ানদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এই সুযোগে ভালো করে ইংরাজি শিখে নেন। ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবীর সঙ্গে তাঁর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়। কোম্পানির কাজে এর অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে রং পুরে কাজ করেন-মোটামুটি ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তিনি দু’বার ভূটান সীমান্তে যান কোম্পানির হয়ে দৌত্যকার্যে ডিগবীর সাহচর্যে তাঁর সমস্ত নূতন চিন্তা এই সময়ের মধ্যেই পরিপক্কতা লাভ করে। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসী ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবীতে) ‘তুহফাতুল মুবাহ হিন্দীন’ । বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রক্ষ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বের হয়ে গেল ‘বেদান্তগ্রন্থ’, ‘বেদান্তসার’, ‘কেনোপনিষদ’, ‘ঈশোপনিষদ’, ‘কঠোপনিষদ’, ‘মাণ্ডূক্যোপনিষদ’ ও ‘মুণ্ডকোপনিষদ’। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন। এই সব প্রতিবাদ কটুক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ । ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’র প্রতিবাদে রামমোহন ”ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রক্ষনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করে । এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ‘ব্রাক্ষসমাজ’ নাম ও রূপ দেন ।
বেদান্ত-উপনিষদগুলি বের করবার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত প্রমাণ করে পুস্তিকা লিখলেন ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ । প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হল ‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’। তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা বের হয়। এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আইন করে সহমরণ-রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও গোঁড়ারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। এই চেষ্টায় বাধা দেবার জন্য রামমোহন বিলেত যেতে প্রস্তুত হলেন।
বাংলায় ও ইংরাজীতে সাময়িকপত্র ছাড়া তিনি ফারসীতে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র চালিয়েছিলেন এক বছর ধরে (১৮২২-২৩ খ্রী)। সংবাদপত্রটির নাম ‘মিরাতুল-আখবার’। ভারতবর্ষের নানাস্থানে এমনকি ইরাণেও এই ফারসী সংবাদপত্রটির গ্রাহক ছিল। গভর্নর জেনারেল যখন হুকুমজারি করলেন যে, সংবাদ ও সাময়িকপত্র মাত্রই রেজেস্টারিভুক্ত হওয়া প্রয়োজন, তখন তিনি সে হীনতা স্বীকার না করে কাগজটি উঠিয়ে দিলেন।
১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। দিল্লীর বাদশাহ তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে ভার দিলেন বিলেতে গিয়ে রাজদরবারে যেন বাদশাহের তনখা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। সেখানে সম্ভ্রান্ত ও বিদ্বতসমাজে তাঁর প্রচুর সমাদর হয়েছিল। ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। ফিরে ব্রিস্টলের নিকটবর্তী স্টেপলটনহিল গ্রামে থাকার সময়ে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৮ অক্টোবর দেহ ব্রিস্টলে সমাথিস্থ হয়।
তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতবর্ষকে এগিয়ে যাবার পথনির্দেশ করেছিলেন। তিনিই আমাদের দেশের প্রথম লিঙ্গুয়িস্ট। বাংলা ছাড়া তিনি জানতেন সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, হিব্রু (কিছু) ও গ্রীক (কিছু)। বাংলা গদ্যের তিনি জনক-এই অর্থে যে তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যে স্বীর স্বাধীন চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন এবং তাঁর ভাষা কোনও গ্রন্থের অনুবাদ-গন্ধী নয়। তাঁর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (ইংরেজীতে লেখা, পরে বাংলায় অনুদিত) বাংলা ভাষায় তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক। স্বাধীন চিত্ততার প্রকাশে তাঁর জুড়ি নেই। সংস্কৃত কলেজ করবার আবশ্যক নেই, আমাদের ইংরেজী ও বিজ্ঞান শিখতে হবে-উচ্চকণ্ঠে এ-কথা ঘোষণা করবার সাহস সেকালে তাঁর ছাড়া অন্য কারও ছিল না।