গ্রিক পৌরাণিক গল্প মূলত দেব–দেবী ও অদ্ভুত ক্ষমতা সম্পন্ন প্রাণীদের নিয়ে গল্প ও কিংবদন্তির সংকলন। হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল গ্রিক পুরাণের গল্পগুলো। কে বা কারা এসব রচনা করেছেন, তার সঠিক তথ্য ইতিহাসে তেমন পাওয়া যায় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে গল্পগুলো। এসব গল্পের বেশির ভাগই ছিল ভয়ংকর সব যুদ্ধের বর্ণনা। কখনো মানুষ, কখনো দেব–দেবীরা লড়ছেন ভয়ংকর সব প্রাণীর বিরুদ্ধে। বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, নৈতিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে এসব কাহিনিতে। গ্রিক পুরাণে দেখা যায়, মানুষের মতো দেবতাদেরও কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার আর খারাপ কাজের জন্য তিরস্কার জোটে তাঁদের ভাগ্যে। গ্রিসের বিভিন্ন মন্দির ও মাটি খুঁড়ে পাওয়া নানা পুরাকীর্তিতে পাওয়া গেছে অনেক গল্পের বর্ণনা। আমরা এখানে গ্রিক পুরাণের কিছু কিংবদন্তি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।
দেবীদের কলহের জেরে ট্রোজান যুদ্ধ শুরু: গ্রিক পৌরাণিক গল্প
পেলিয়াস আর থেটিসের বিয়ের ভোজে অলিম্পাসের সমস্ত দেব দেবীদেরই নিমন্ত্রণ ছিল। ডাকা হয়নি শুধু ঝগড়ার দেবী এরিসকে। মহা ক্রোধে এরিস ঠিক করলেন, অলিম্পাসের সবাইকে সাজা দিতে হবে! তিনি দেবদেবীদের মাঝখানে ছুঁড়ে দিলেন একটি সোনার আপেল, তাতে লেখা ‘সবচেয়ে সুন্দরী যে, তার জন্য’। তিনজন দেবী আপেলটির অধিকার চেয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু করলেন— সংসারের দেবী হেরা, মেধা এবং গুণের দেবী এথিনা, আর প্রেমের দেবী আফ্রোদিতে। এই তিন দেবীর মধ্যে কে সবচেয়ে সুন্দরী, এবং আপেলটি কার প্রাপ্য, সে-বিচার করার দুঃসাহস কোনও দেবতা করলেন না, এমনকী স্বয়ং দেবরাজ জিউসও না।
অতএব অনেক আলোচনার পরে তিন দেবীকে বলা হল ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের কাছে যেতে, কারণ তিনি নারীর সৌন্দর্যের মর্ম বোঝেন এবং সুবিচার করে থাকেন। তিন দেবী অতঃপর প্যারিসের কাছে গিয়ে নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে তাঁর মন জয় করার চেষ্টা করলেন। প্যারিস যখন মনস্থির করতে পারলেন না, তখন তিনজনেই তাঁকে নানা ভাবে ঘুষ দেবার চেষ্টা করলেন। হেরা বললেন, তোমায় আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজত্বের রাজা করে দেব। এথিনা বললেন, তোমায় আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবার মাননীয় যোদ্ধা করে দেব। আর আফ্রোদিতে বললেন, তোমার সঙ্গে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেনের মিলন ঘটিয়ে দেব।
প্যারিস আফ্রোদিতের দাবি মেনে নিলেন এবং তাঁকে সোনার আপেলটি পুরস্কার দিয়ে আজীবন নিজেকে এবং নিজের দেশ ট্রয়কে হেরা আর এথিনার বিরাগভাজন করে তুললেন। অতএব ট্রয়ের যুদ্ধের পিছনে যতটা না ছিল মানুষের ভুলভ্রান্তি, তার চেয়েও বেশি ছিল দেবতাদের হিংসা এবং প্রতিযোগিতা ।
আরও পড়ুন: চালাক মাকড়সা আনান্সির গল্প – ঘানা’র পৌরাণিক গল্প
হেরাক্লিস ও হাইড্রার যুদ্ধ: একটি গ্রিক পৌরাণিক গল্প
গ্রিক পুরাণে ৯ মাথার এক ভয়ংকর সাপের নাম হাইড্রা। জলাভূমিতে বাস করত। আর হেরাক্লিস বা হারকিউলিস ছিলেন গ্রিক দেবতা জিউসের সন্তান। তবে পুরোপুরি দেবসন্তানের মর্যাদা ছিল না তাঁর। মা মানুষ হওয়ায় হেরাক্লিস দেবতাদের মতো অমরত্ব পাননি। অমরত্বের জন্য হেরাক্লিসকে ১২টি কঠিন কাজ দেওয়া হয়। এর একটা ছিল হাইড্রাকে পরাস্ত করা।
হাইড্রার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আগুনের বর্শা ছুড়ে মারেন হেরাক্লিস। জবাবে হাইড্রা হেরাক্লিসকে আক্রমণ করতে এলে তরবারি দিয়ে কেটে ফেলেন মাথা। কিন্তু মরে যাওয়ার বদলে হাইড্রার কাটা মাথা থেকে গজিয়ে ওঠে আরও দুটি মাথা। আসলে হাইড্রার জাদুকরি শক্তি ছিল এটি। যতবারই মাথা কাটা হোক না কেন, দ্বিগুণ হয়ে গজিয়ে যাবে সেটা।
যাহোক, হেরাক্লিসের সঙ্গে ছিল বন্ধু লোলাস। হাইড্রার মাথা গজানো বন্ধ করার একমাত্র অস্ত্র হলো আগুন। হেরাক্লিস হাইড্রার মাথা কাটার সঙ্গে সঙ্গে কাটা স্থান আগুনে পুড়িয়ে দিতে থাকে লোলাস। দীর্ঘ সময় ধরে এ বহুমুখী দানবের সঙ্গে এভাবে লড়াই করে দুই বন্ধু। অবশেষে একসময় পরাজিত হয়ে মারা যায় হাইড্রা। বিজয়ের আনন্দ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে দুই বন্ধু।
আরও পড়ুন: নীল সাগরের ক্ষুদে দৈত্য ব্ল্যাক সোয়ালোয়ার
পার্সিসাস ও মেডুসার লড়াই: একটি গ্রিক পৌরাণিক গল্প
গ্রিক পুরাণের অন্যতম দানব মেডুসা‘র মাথায় চুলের বদলে লিকলিক করত অজস্র সাপ। ছিল ভয়ংকর দাঁত। চোখের দৃষ্টিতে ছিল ভয়ংকর জাদুকরি শক্তি। কেউ সে চোখের দিকে তাকালে সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হতো পাথরের মূর্তিতে।
রাজাকে খুশি করার জন্য পার্সিসাস নামের এক যোদ্ধা এই দানবকে হত্যা করতে বেরিয়ে পড়েন। পার্সিয়াস বেরিয়ে পড়লেন এই অসম্ভব কাজটি সম্পন্ন করতে। কিন্তু একা এই কাজটি করা সম্ভব? প্রায় অসম্ভব কাজটি করতে পার্সিয়াসের পাশে ছিলেন জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা স্বয়ং, আর দেবতাদের বার্তাবাহক হার্মিস। তারা পার্সিয়াসকে শিখিয়ে দিলেন বেশ কিছু কৌশল, আর দিলেন বিশেষ কিছু জিনিস। অ্যাথেনা তাকে দিলেন নিজের বুকের পাতলা বর্ম (মতান্তরে ব্রোঞ্জের একটি ঢাল), হার্মিস তাকে দিলেন একটি তরবারি আর হেডিসের জাদুর টুপি- যা পরলে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে থাকা যায়, জাদুর থলি, যার ভেতরে যেকোন কিছু আঁটানো যায়। হার্মিস তাকে আরো দিলেন পাখাওয়ালা এক জোড়া জুতো, যা পরে যেখানে খুশি যাওয়া যায়। এতকিছু পেয়ে পার্সিয়াসের মনে বল পেল, মেডুসাকে হত্যা করা এখন তার কাছে আর কোনো ব্যাপারই নয়।
বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে মেডুসার দ্বীপে এসে পৌঁছুল পার্সিয়াস। গর্গনরা তিন বোনই থাকত এখানে। দেবী অ্যাথেনা পার্সিয়াসকে মেডুসা কোনটি তা চিনিয়ে দিলেন, কারণ অন্য দুই বোন ছিল অমর। তিনি তাকে আরও বললেন, মেডুসার দিকে যেন সে কোনভাবেই সরাসরি না তাকায়। কারণ তাতে সে পাথর হয়ে যাবে। তাই তিনি চকচকে ব্রোঞ্জের সেই ঢালের মাঝে মেডুসার প্রতিফলনের দিকে তাকে চোখ রাখতে বলেন।
পার্সিয়াস জাদুর জুতো জোড়া পায়ে পরে উড়ে উড়ে সেই ঢালের দিকে তাকিয়ে মেডুসার দিকে লক্ষ রাখতে লাগল। একসময় মেডুসা এসে পড়ল তার হাতের নাগালে, সে ঢালের দিকে তাকিয়ে তলোয়ারের এক কোপে মেডুসার মাথা কেটে ফেলল। ঢাল থেকে চোখ না সরিয়েই মেডুসার মাথাটি মুঠি করে ধরে জাদুর থলেতে ঢুকিয়ে ফেলল। অন্য দুই বোন মেডুসার এই পরিণতি খেয়াল করে তাকে ধরবার আগেই জাদুর টুপি আর জুতোর সাহায্যে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।