তিন রাজকুমার ও রাজকুমারী নওরোন্নিহার একটি সুন্দর ও মূল্যবোধের গল্প – এই কাহিনীটি সহস্র এক আরব্য রজনীর গল্প সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।
অনেক দিন আগের কথা। আরব দেশের এক সুলতান ছিলেন, যার তিন পুত্র ছিল। বড় ছেলের নাম ছিল হুসেন, মাঝের ছেলের নাম আলী, আর ছোট ছেলের নাম আহমেদ। এই তিন ভাই ঠিক তাদের বাবার মতোই বুদ্ধিমান এবং দয়ালু ছিল। সুলতানের ভাই, যিনি পাশের রাজ্য শাসন করতেন, তার ছিল এক মেয়ে, নাম নওরোন্নিহার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, নওরোন্নিহার ছোট থাকতেই তার মা-বাবা মারা যান। সুলতান তার ভাইয়ের এই ছোট্ট মেয়েটিকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে আসেন এবং তাকে নিজের সন্তানদের মতো করেই বড় করতে থাকেন। নওরোন্নিহারও বড় হতে হতে স্মার্ট এবং সদয় হয়ে ওঠে।
বছর গড়িয়ে গেল, আর তিন ভাইয়ের চোখের সামনে নওরোন্নিহার ধীরে ধীরে অপরূপা হয়ে উঠতে থাকল। হঠাৎ একদিন সুলতান লক্ষ করলেন, তার তিন ছেলেই নওরোন্নিহারের প্রেমে পড়েছে। রাজকন্যার বিয়ের বয়সও তখন হয়ে এসেছে, তাই একদিন তিন পুত্রই সুলতানের কাছে গিয়ে রাজকন্যার হাতে বিয়ের প্রস্তাব জানায়। সুলতান চিন্তায় পড়লেন—এখন তিনি কীভাবে তার ছেলেদের মধ্যে একজনকে বেছে নেবেন? ভাবলেন, এটা নির্ধারণ করার জন্য তাদের একটা চ্যালেঞ্জ দিতে হবে।
সুলতানের ছিল বিরল আর অনন্য জিনিসের প্রতি এক বিশেষ ভালোবাসা। তাই তিনি ছেলেদের বললেন, “তোমরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করো এবং প্রত্যেকে এমন একটি অনন্য ও দুর্লভ জিনিস নিয়ে আসো, যা সত্যিই অসাধারণ। যার জিনিসটি সবচেয়ে বেশি অনন্য হবে, সেই নওরোন্নিহারকে বিয়ে করবে।” চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তিন ভাই বেরিয়ে পড়ল। তারা শহরের এক প্রান্তের সরাইখানায় এক বছরের মাথায় আবার মিলিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রা শুরু করল।
আরও পড়ুন: তেনালি রামা’র গল্প ‘অপয়া রাময়া’
জ্যেষ্ঠ পুত্র হুসেন রওনা হলেন বিসনগরের দিকে। এই রাজ্যটি ভারতীয় উপকূলের পাশে অবস্থিত এবং সেখানে ধন-সম্পদের জাঁকজমক নিয়ে প্রচুর গল্প শুনেছিলেন তিনি। দীর্ঘ তিন মাসের যাত্রার পর তিনি পৌঁছালেন বিসনগরে, আর দেখলেন শহরটি তার কল্পনার চেয়েও বেশি সমৃদ্ধ। তিনি একটি সরাইখানায় ঘর ভাড়া নিলেন এবং শহরের বণিকদের এলাকায় ঘুরতে শুরু করলেন। এখানেই তিনি তার খোঁজের বস্তুটি খুঁজে পেলেন—একটি পুরোনো, ছিদ্রযুক্ত কার্পেট। একজন লোক সেই পাটি বিক্রি করছিল এবং দাম চাইছিল ত্রিশ স্বর্ণ মুদ্রা।
হুসেন বিস্মিত হলেন—একটা পুরোনো কার্পেটের জন্য এত দাম কেন? লোকটি তখন বলল, “এটা কোনো সাধারণ কার্পেট নয়, এটি এক জাদুকরী কার্পেট। যে কেউ এই কার্পেটে বসে যেকোনো জায়গার কথা চিন্তা করবে, সে মুহূর্তের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাবে।” হুসেন পরীক্ষা করে দেখলেন, এবং সত্যি, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নিজের কক্ষে ফিরে এলেন। তিনি তখনই কার্পেটটি কিনে নিলেন, নিশ্চিত ছিলেন যে এই জিনিসটি তাকে বিজয়ী করবে।
মধ্যম পুত্র আলী চার মাস ধরে পারস্যের রাজধানী শিরাজে ভ্রমণ করলেন। শহরের বাজারে একদিন, তিনি একটি হাতির দাঁতের তৈরি দূরবীন দেখতে পেলেন। এর দামও ছিল ত্রিশ স্বর্ণমুদ্রা, যা তার কাছে অদ্ভুত লাগল। বিক্রেতা বলল, এই দূরবীন দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো কিছু দেখা যায়। আলী পরীক্ষা করতে চাইলে বিক্রেতা তাকে রাজকুমারী নওরোন্নিহারকে দেখাতে বললেন। আলী দেখলেন, নওরোন্নিহার তার বন্ধুদের সাথে হাসি-মশকরা করছে। আনন্দিত হয়ে আলী দূরবীনটি কিনে নিলেন।
কনিষ্ঠ পুত্র আহমেদ গেলেন সমরকন্দ। বাজারে একদিন তিনি দেখলেন, এক বিক্রেতা এক সোনার আপেল বিক্রি করছে, যার দাম পঁয়ত্রিশ স্বর্ণমুদ্রা। আপেলটি দেখে আহমেদ বুঝতে পারলেন, এর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব আছে। বিক্রেতা বলল, এটি একটি জাদুর আপেল—এর ঘ্রাণ যে কোনো মরণাপন্ন ব্যক্তিকেও সুস্থ করতে পারে। আহমেদ আপেলটি পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলেন এবং কিনে নিলেন।
আরও পড়ুন: বিধানচন্দ্র রায় : বাংলার রূপকার হয়ে ওঠার কাহিনী
এক বছর পর তিন ভাই আবার সরাইখানায় মিলিত হল। প্রথমে আলী তার জাদুকরী নল দিয়ে নওরোন্নিহারকে দেখতে চাইলেন। কিন্তু তিনি যা দেখলেন, তা তাকে অবাক করে দিল—রাজকুমারী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী। তিন ভাই বুঝতে পারলেন, তাদের একসাথে কাজ করতে হবে। হুসেন তার জাদুর কার্পেটে সবাইকে নিয়ে গেল রাজকুমারীর কক্ষে। আহমেদ তার জাদুর আপেল রাজকুমারীর নাকে ধরে দিলেন। আর তাতেই রাজকুমারী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
শেষ পর্যন্ত রাজকুমারী নওরোন্নিহার – কি হল?
সুলতান তিন পুত্রের দুর্লভ জিনিসগুলো দেখে মুগ্ধ হলেন, কিন্তু এবারও তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না কে রাজকুমারীকে বিয়ে করবে। তাই তিনি নতুন আরেকটি পরীক্ষা করলেন—তিন ভাইকে তীর ছুঁড়ে মারতে হবে, আর যার তীর সবচেয়ে দূরে যাবে, সে-ই হবে বিজয়ী। প্রথমে হুসেন, তারপর আলী, আর শেষে আহমেদ তার তীর ছুঁড়ল। আহমেদের তীর এত দূরে গিয়ে পড়ল যে, কেউ তা খুঁজে পেল না। সুলতান বুঝলেন, আহমেদ বিজয়ী। সেই দিনই আহমেদ ও নওরোন্নিহারের বিয়ে হল, আর তারা সুখে-দুঃখে জীবন কাটাতে লাগল।