সভ্যতার অগ্রগতির সাথে তালমিলিয়ে কর্মব্যস্ততা মানুষ ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে ফলে পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ার জন্য নীতিশিক্ষা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর ক্ষেত্রে ভাল গল্পের সত্যই বিকল্প নেই। এই প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই এই প্রচেষ্টা। এগুলি উপস্থাপনায় যদি কারোর এতটুকুও উপকার হয় তবে এই প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করব।
মূর্খ যখন বিত্তবান হয় – একটি নীতি শিক্ষার গল্প
মূর্খ যখন বিত্তবান হয়:-
একদা একটি ইঁদুর খাবার খুঁজতে খুঁজতে রাজার ঘরে প্রবেশ করে, কোন খাবার না পেয়ে একটি হীরার টুকরো গিলে ফেলল। হীরার টুকরো চুরি হওয়ার কারণে রাজ প্রাসাদে সবার ঘুম হারাম হয়ে গেল!
রাজা মশাই জ্যোতিষীকে ডাকলেন।
জ্যোতিষী বলে, “হীরার টুকরো ইঁদুরে খেয়ে ফেলছে।”
সেনাপতি রাজার হীরা উদ্ধারের জন্য রাজ্যময় পুরস্কার ঘোষণা করলো। একজন শিকারীকে ইঁদুর মেরে হীরা উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হলো।
শিকারী যখন ইঁদুর মারতে ইঁদুরের বাসস্থানে প্রবেশ করে তখন দেখতে পেলো, শত শত ইঁদুর একে অন্যের সাথে দল বেধে রয়েছে। আর একটা মাত্র ইঁদুর সবার থেকে আলাদা এক জায়গায় একটি ইটের ওপর যেন সিংহাসনে বসে আছে।
শিকারী তখন ওই ইঁদুরটাকে ধরে তার পেট চিরে হীরার টুকরো বের করে সেটা রাজার হাতে তুলে দিলো।
রাজা মশাই অনেক খুশি হয়ে শিকারীকে তার প্রাপ্য পুরস্কার দিয়ে দিলেন।
রাজা শিকারীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হাজারো ইঁদুরের মধ্যে তুমি কিভাবে বুঝলে যে ওই ইঁদুরটাই হীরা চুরি করেছে”?
শিকারী জবাবে বলল “এটা খুবই সহজ মহারাজ! মূর্খ যখন হঠাৎ বিত্তবান হয়ে যায় তখন নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা মনে করে, নিজের জাতির সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এই মূর্খ ইঁদুরটাও তাই করেছিলো। হীরা চুরি করে নিজেকে সবচেয়ে ধনী এবং ইঁদুরদের রাজা ঘোষণা করে আলাদা ভাবে বসে ছিল ।”
নীতিকথা: হঠাৎ অর্থাগমে, স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব ভুলে গেলে ধ্বংস খুব নিকটে চলে আসে।
আরও পড়ুন: মোল্লা নাসিরুদ্দিন বা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প
বিপদ যখন দরজায় ধাক্কা দেয় – নীতি শিক্ষার গল্প
বিপদ যখন দরজায় ধাক্কা দেয়:-
গল্পটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কিভাবে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা আলাদাভাবে বিপত্তির মোকাবিলা করে। এক বাবা একটি ডিম, একটি আলু, এবং কিছু চা পাতা তিনটি পৃথক পাত্রের মধ্যে ফুটন্ত জলে রেখেছিলেন।
তিনি তার ছেলে কে দশ মিনিটের জন্য পাত্রগুলির উপর নজর রাখতে বলেছিলেন ও এই দশ মিনিট শেষে তিনি ছেলেকে আলুর খোসা ছাড়াতে, ডিমের খোসা ছাড়াতে এবং চা পাতাগুলো ছেঁকে নিতে বললেন। ছেলেটি অবাক হয়ে গেল!
তার বাবা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে জিনিসগুলি প্রত্যেকটিই উষ্ণ জলের পাত্রের মধ্যে একই অবস্থায় রাখা হয়েছিল কিন্তু তারা কিভাবে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করেছে সেটাই লক্ষণীয়।
আলু যখন নরম, ডিম তখন কঠিন আবার চা জলকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে। প্রত্যেক মানুষই এই দ্রব্যগুলোর মত, ভিন্ন ভিন্ন । যখন বিপত্তি আসে, আমরা ঠিক আমাদের মতো করেই প্রতিক্রিয়া জানাই।
নীতিকথা: কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া করব সেটা আমরাই বেছে নিতে পারি।
সিংহ ও ইঁদুর – বহুল প্রচলিত একটি নীতি শিক্ষার গল্প
সিংহ ও ইঁদুর:-
একদিন এক সিংহ তার গুহায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় একটি ছোট ইঁদুর ছোটাছুটি করতে করতে সিংহের নাকের এক ছিদ্রে ঢুকে পড়েছিল।
সিংহের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ফলে সে রেগে গিয়ে ইঁদুরটিকে থাবা দিয়ে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু ইঁদুরটি অত্যন্ত বিনয়ী সুরে সিংহের কাছে প্রার্থনা করেছিল তাকে না মেরে ফেলার। ইঁদুরটি এও বলেছিল যে সময় হলে সেও সিংহের উপকারে আসতে পারে।
ইঁদুরের মতো এত ছোট জীব, সিংহের মতো এত বিশাল জন্তুকে কীভাবে রক্ষা করবে সে কথা ভেবে সিংহের হাসি পেল আর দয়াপরবশ হয়ে সিংহ ইঁদুরটিকে ছেড়ে দিল। এর কিছুদিন পরে সেই সিংহটি একদিন একটি দড়ির শক্ত ফাঁদে আটকে পড়ল ।
ফাঁদে পড়ে যাওয়া সিংহটির গর্জন শুনে ছোট্ট ইঁদুরটি ছুটে চলে এসে সিংহর দুরবস্থার সম্মুখীন হল। ছোট্ট ইঁদুরটি তার ধারালো দাঁত দিয়ে ফাঁদের দড়িটি কাটতে শুরু করল এবং এভাবে অবশেষে সে সিংহকে ফাঁদ থেকে মুক্তি দিল।
মুক্তি পেয়ে সিংহটি ইঁদুরকে অনেক ধন্যবাদ জানাল আর সেই সঙ্গে বলল যে ,”তোকে আমি অবজ্ঞা করেছিলাম একসময়। কিন্তু আজ বুঝলাম ,কাউকে ছোট করতে নেই ।”
নীতিকথা: সময়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বন্ধু প্রাণ বাঁচাতেও পারে।
আরও পড়ুন: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূতের গল্প
খরগোশ ও কচ্ছপ – চিরন্তন নীতি শিক্ষামূলক গল্প
খরগোশ ও কচ্ছপ:-
খরগোশ কি জোরেই ছোটে, যেন বাতাসের আগে উড়ে চলে, আর কচ্ছপ চলে আসতে আসতে হেলেদুলে। কচ্ছপের ঐ রকম হাঁটা দেখে এক খরগোশ একদিন হেসে লুটোপুটিঃ কি হাঁটাই শিখেছ, দাদা! –এত টিটকারি কিসের, এস না পাল্লা দিই! —পাল্লা? হাসালে, বেশ, বলো কোথায়, কতদূর যাওয়ার পাল্লা? কখন শুরু হবে?
কচ্ছপ বললে, এখনই। ঐ যে অনেক দূরে নদীর ধারে একটা বটগাছ দেখা যাচ্ছে, এস দেখি ঐখানে কে আগে যেতে পারে! বলার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা শুরু হয়ে গেল ;
খরগোশ একটু দৌড়েই পিছনে তাকিয়ে দেখে কচ্ছপ অনেক পিছে পড়ে আছে। ভীষণ রোদ্দুর। পাশেই গাছের নীচে একটা ঝোপ দেখে ভাবলে এই ছায়ায় কিছুটা ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। পরে যখনই যাই ওর আগে পৌছতে পারব। এই ভেবে খরগোশ সেই গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ল ।
কচ্ছপ কিন্তু রোদ্দুর-টদ্দুর গ্রাহ্য না করে ধীরগতিতে একটুও না থেমে চলতে লাগল। বেলা পড়ে এলে খরগোশের ঘুম ভাঙল। সে তখন আশেপাশে তাকিয়ে কচ্ছপকে না দেখতে পেয়ে ছুটল নদীর তীরের সেই বট গাছের দিকে। সেখানে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখল কচ্ছপ তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে ।
নীতিকথা: ধীর ও স্থির ব্যক্তিরাই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে।
শিয়াল ও আঙুর ফল – প্রবাদপ্রতিম নীতিশিক্ষার গল্প
শিয়াল ও আঙুর ফল:-
তিন দিন ধরে অনবরত বৃষ্টি হওয়ার কারণে একটি শিয়াল খাবারের খোঁজে কোথাও বেরোতে পারেনি। খিদের জ্বালায় থাকতে না পেরে শিয়ালটি বনের মধ্যে খাবারের সন্ধানে ঘুরতে লাগল ।
হঠাৎ একটি ঝোপের দিকে তার নজর পড়ল।সে দেখল ঝোপের পাশে একটি আঙুরগাছ এবং অনেক পাকা আঙুরের থোকা ঝুলছে সেখানে। খিদের জ্বালায় সেই আঙুর খেয়েই পেট ভরাবে বলে শেয়ালটি মনস্থির করল।
কিন্তু গাছের এত উপরে থাকা আঙুরের থোকা গুলির সে কীভাবে নাগাল পাবে সেই নিয়ে ভাবতে শুরু করল । কিন্তু শিয়ালটি তার কোনও উপায়ই বার করতে পারল না। অবশেষে বিফল মনোরথ হয়ে সে সেই স্থান পরিত্যাগ করল ।
ফেরার পথে সে বলতে লাগল -“আঙুর ফল টক; ওই আঙুর আমি খেতেও পারতাম না আর খেলেও আমার পেট ভরত না”
নীতিকথা: নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্য পরনিন্দা করা অনুচিত।